কার ক্ষমতা বেশি। মশা না মানুষের। গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বাসিন্দারা সেই ক্ষমতার লড়াইয়ে নেমেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো ক্ষতার দৌড়ে মশাই বিজয়ী হচ্ছে। মশা নামক ক্ষুদে এ প্রাণীটি দিন দিন এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে যে, তাদের দমানোর কোনো ফর্মুলাই কাজে আসছে না। নগরবাসী অসহায়ের মতো মশাদের খাবারে পরিণত হচ্ছে। অ্যারোসল, ইলেকট্রিক ব্যাট, কয়েল অথবা সিটি করপোরেশনের ফগার মেশিনের ধোয়া কোনোটাই কাজে আসছে না মশাদের বিরুদ্ধে। বাসিন্দাদের মতে এত মশা কখনো দেখেনি ঢাকার মানুষ।
গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানীতে মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দিন নেই, রাত নেই প্রতি মুহূর্তেই চলছে মশার অত্যাচার। বাসা-বাড়ি, অফিস, খেলার মাঠ- সর্বত্রই মশা আর মশা। মশার অত্যাচারে অস্থির হয়ে উঠেছে নগরবাসী। বিমানবন্দরেও মশার ভয়াবহ উৎপাত চলছে। এমনকি মশার কারণে ফ্লাইটের সময় পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রতি বছর এ খাতে বাজেট বাড়ালেও মশার যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই মুক্তি মিলছে না। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী। সিটি করপোরেশনের যথাযথ দায়িত্ব পালন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো রাজধানীতেই মশার ভয়াবহ উপদ্রব চলছে। এর মধ্যে বনশ্রী, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, মুগদা, মানিকনগর, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, মিরপুর, ধোলাইখাল, মীর হাজিরবাগ, যাত্রাবাড়ী, ধলপুর, শ্যামপুর, কামরাঙ্গীরচর, সূত্রাপুর, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, ফকিরেরপুল, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, কুড়িল, হাজারীবাগ, রায়েরবাজার এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। এ ছাড়া নগরীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডিতেও বেড়েছে মশার ভয়াবহ উপদ্রব। সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিদিন সকাল-বিকেল দু’বেলা ওষুধ প্রয়োগের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
মিরপুরের মনিপুর পীরের বাগের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, দিন-রাত সব সময় মশার অত্যাচার চলছে। ভাত খেতে গেলেও মুখের মধ্যে মশা ঢুকে যাচ্ছে। মুগদার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, মশার উপদ্রব এতই বেশি যে, মশারি একটু উঁচু করে বাইরে বের হতে গেলেই মশার ঝাঁক ঢুকে যাচ্ছে। পরে এক ঘণ্টা ধরে মশারির মধ্যে থাকা মশা মারতে হচ্ছে। না হলে ঘুমানোর উপায় থাকে না। বনশ্রীর বাসিন্দা মেহেদী হাসান বলেন, এ বছর স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মশার উপদ্রব চলছে। এর আগে এত মশার যন্ত্রণা দেখিনি। মশারি, স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। উত্তরার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, উত্তরার প্রতিটি সেক্টরেই মশার উৎপাত চলছে। জানালায় নেট লাগানো থাকলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ১০-১২ তলাতেও মশার আক্রমণ থেকে রেহায় পাওয়া যাচ্ছে না।
উত্তরার ৪নং সেক্টরের ৩ নং রোডের বাসিন্দা শামীম আহমেদ বলেন, বাসায় সারাক্ষণই মশারি খাটিয়ে রাখতে হচ্ছে। দিনে যে হারে মশা কামড়ায় তাতে মশারি খোলার জো নেই। তিনি বলেন, মানুষের চেয়ে এখন মশার ক্ষমতা বেশি। কেননা কোনা মানুষের পক্ষে আরেকজনের শরীর থেকে রক্ত বের করে নেয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু মশা নির্বিঘেœ রক্ত খেয়ে যাচ্ছে, আমরা কিছুই করতে পারছি না।
হাতিরঝিলের পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় মশার উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপক হারে। এ ছাড়া ওই এলাকায় কয়েকটি বস্তি ও ঘুপচি এলাকা রয়েছে। এ কারণে মগবাজার, মধুবাগ, মীরবাগ, রামপুরাসহ আশপাশের এলাকায় মশার অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
উত্তরায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশার অত্যাচার চলছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে মশার উৎপাতের কারণে মালয়েশিয়াগামী একটি ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বে গন্তব্যের উদ্দেশে উড়ে যায়। উড়োজাহাজের ভেতরে ‘মশার ঝাঁক’ ঢুকে পড়ার ঘটনায় বিমানবন্দরজুড়ে শুরু হয় হুলস্থুল কাণ্ড।
খিলগাঁওয়ের গৃহবধূ স্নেহা ইসলাম বলেন, মশার অত্যাচারের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। মশার অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কয়েলেও কাজ হয় না। বাসায় ¯েপ্র করলে কিছু সময় পর আবার পুরো ঘর মশায় ভরে যায়। রাতে মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে মশা। বাসাবো খালের নোংরা পানিতে মশার লার্ভা ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। এ ছাড়া ওই এলাকায় ছোট ছোট পচা পানির জলাশয় রয়েছে। এসব স্থানে মশার বংশবিস্তার ঘটছে।
বাসাবোর বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, শুধু শুনি, সিটি করপোরেশন অনেক উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাদের কর্মীদের দেখা পাওয়া যায় না। হঠাৎ কখনো বিকট শব্দে ওষুধ দিতে দেখি। সেদিনের মতো মশার দমন হলেও পরদিন থেকে আবার একইভাবে মশার উপদ্রব চলতে থাকে।
রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন গত পাঁচ বছরে ১৩১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত পাঁচ বছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করেছে ৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বর্তমান অর্থবছরে (২০১৭-১৮) মশা নিয়ন্ত্রণে মোট ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা বাজেট রেখেছে। গত বছর (২০১৬-১৭) ব্যয় হয় ১৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর আগের বছর (২০১৫-১৬) ব্যয় করে ৯ কোটি ৯০ লাখ। ২০১৪-১৫ বছরে ব্যয় হয় ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তার আগের বছর (২০১৩-১৪) ব্যয় হয় মাত্র ২ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন গত পাঁচ বছরে মশা নিয়ন্ত্রণে মোট ব্যয় করেছে ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বর্তমান অর্থবছরে (২০১৭-১৮) ২০ কোটি টাকা বাজেট রেখেছে। গত বছর (২০১৬-১৭) ব্যয় হয় ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর আগের বছর (২০১৫-১৬) ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় হয় সাত কোটি ৮০ লাখ টাকা। তার আগের বছরও (২০১৩-১৪) ব্যয় হয় সাত কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এভাবে শতাধিক কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কোনোভাবেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বরং গত কয়েক বছরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর পাশাপাশি নতুন করে ভাইরাসজনিত চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এডিস মশা থেকেই এ রোগ ছড়ায়। কোনো কোনো পরিবারের সবাই একসাথে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চরম বিপাকে পড়েন। এ রোগে আক্রান্তদের প্রচণ্ড জ্বরের সাথে সারা শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়। বিশেষ করে হাড়ের গিরায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথার কারণে হাঁটা চলা বন্ধ হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্তরা তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত ভুগেছেন। চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে শেষ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কল সেন্টার চালু করে নিজস্ব ডাক্তার দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে তাদের ফিজিওথেরাপিও দেয়া হয়।
রাজধানীতে বর্তমানে মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়া নগরবাসীর মনে আবারো চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৭০ শতাংশ মশা নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ছাদে তৈরি বাগানে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত ভবন, গাছের কোটর, এসি ও ফ্রিজ থেকে জমা পানি, ফুলের টব,পরিত্যক্ত টায়ার, খালি ক্যান ও ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিতে মশার বংশ বিস্তার বেশি ঘটে। এসব স্থানে করপোরেশনের মশক নিধনকর্মীরা যেতে পারেন না। এ জন্য মশার বংশবিস্তার রোধে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীরা বলেন, হস্তচালিত মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানোর সাথে সাথেই মশা মরে যায়। কিন্তু এ মেশিন দিয়ে দ্রæত কাজ করা যায় না। আর ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করলে অল্প সময়ে বিশাল এলাকায় ওষুধ ছিটানো সম্ভব। কিন্তু এ মেশিনের বিকট শব্দে মশা আগেই পালিয়ে যায়। যে কারণে কাজে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল ডা: সালাহ উদ্দীন নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমান সময়ে আবহাওয়ার কারণে মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। এজন্য জানুয়ারির শুরুতে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো হয়েছে। বর্তমান নিয়মিত ওষুধ দেয়া হচ্ছে। গত বছরের থেকে এ বছর ৩৩ ভাগ ওষুধ বেশি প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে জনগণকে আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এ চিকিৎসক। সালাহ উদ্দিন জানান, বর্তমানে ডিএসসিসিতে ২৪৬টি ফগার মেশিন ও ৩৭০টি হস্তচালিত মেশিন রয়েছে। মোট ৩২৮ জন কর্মী এ কাজ তদারকি করেন জানিয়ে তিনি বলেন, আরো জনবল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা: জাকির হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় জানুয়ারিতে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগাম চালানো হয়েছে। বর্তমানে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া ডিএনসিসি এলাকায় থাকা দুই হাজার ১৫৩ বিঘা জলাশয়ের মধ্যে ৯০০ বিঘা জলাশয় নতুন করে পরিষ্কার ও অন্যান্য জলাশয় পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। তিনি জানান, ডিএনসিসিতে বর্তমানে ২৫০টি ফগার মেশিন রয়েছে। আরো ১৫০টি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া হস্তচালিত মেশিন রয়েছে তিনশ। এটিও আরো ১০০ কেনার প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান। ডিএনসিসিতে বর্তমানে ২৮৪ জন মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মী রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
মন্তব্য করুন