বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরুচ্ছে; যা সাম্প্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে যে ৩টি শর্ত পূরণ করতে হয়, বাংলাদেশ তার সবগুলো সফলতার সঙ্গে পূরণ করেছে। তবে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে। এরমধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। গতকাল গুলশানের একটি হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়েশন ফরম দ্য এলডিসি গ্রুপ পিটফলস অ্যান্ড প্রমিসেস’ শীর্ষক পাবলিক ডায়ালগে এসব কথা বলেন সংস্থাটির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর আর্ন্তজাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. ফরাস উদ্দিন আহমেদ, সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষক ফাহামিদা খাতুন ও খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সংলাপে বক্তারা বলেন, এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হলে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। স্বল্প সুদের যেমন ঋণ পাওয়া যাবে না, তেমনি এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত বাণিজ্যসুবিধাও কমে যাবে। তারা বলেন, বাংলাদেশ থেকে এক হাজার তিনশ’ পণ্য বিদেশে রপ্তানি হলেও, তৈরি পোশাকের দখলেই ৮০ ভাগ। তাই পণ্য বহুমুখী করে রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর টেকসই উন্নয়ন ধরে রাখতে উৎপাদনমুখী শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা হারানোর ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশিলতা জরুরি বলেও জানান আলোচকরা।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে সুশাসন থাকলে উত্তরণ সুযোগ হিসাবে দেখা দেবে। আর উত্তরণকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে হলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, চলতি বছরে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলেও ২০২৪ সাল পর্যন্ত সব সুযোগ পাওয়া যাবে। তবে মসৃণ উত্তরণের জন্য জাতিসংঘ তিন বছর পর্যবেক্ষণ করবে। তিনি বলেন, সুশাসন যদি না থাকে, তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা থাকবে না। সেক্ষেত্রে নীতির গুণগত মান এবং যেসব প্রতিষ্ঠান আমাদের সমাজকে টিকিয়ে রাখে, সেগুলোতে দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয় বাংলাদেশ তার সবগুলো সফলতার সঙ্গে পূরণ করছে। এর ফলে জাতিসংঘের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি (সিডিপি) থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রস্তাব প্রাপ্তি ও চূড়ান্ত মর্যাদা পেয়ে যাবে। তবে ওই মর্যাদা রক্ষা নির্ভর করবে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের ওপর। দেশের ভেতরে স্থিতিশীলতা ও ঐক্যবোধ না থাকে, তাহলে উন্নয়নশীলের এই উত্তরণকে সুফল হিসেবে ব্যবহার করা অসম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের ঘটনাকে সামপ্রতিক উন্নয়ন ইতিহাসের একটি অনন্য ঘটনা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এর আগে যেসব দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়েছে, সেগুলো খুব ছোট দেশ ছিল। জনসংখ্যা কম ছিল, উৎপাদনের পরিমাণও কম ছিল। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে যেসব দেশ বের হয়েছে সেসব দেশের প্রবৃদ্ধির পতন ঘটেছে। বৈদেশিক সাহায্যের পতন ঘটেছে। রেমিটেন্সের পতন ঘটেছে। ফলে তাদের যে আর্থিক ব্যবস্থাপনা আছে তার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে কর আদায়ের পরিমাণ যদি না বাড়ে। তবে ওই সব দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
বাংলাদেশ রপ্তানি খাত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই রপ্তানি হচ্ছে একটি মাত্র পণ্যের ওপর নির্ভর করে। সেই ক্ষেত্রে এই রপ্তানি খাতের শ্রমের উৎপাদনশীলতা সর্ব নিম্ন পর্যায়ে আছে। এ বিষয়টা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এলডিসি থেকে বের হলে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হবে। এতে ঋণের বোঝা দেশের সাধারণ মানুষকে বহন করতে হতে পারে। বাংলাদেশ যেসব শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেতো, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হবে। এতে রপ্তানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আবহাওয়াজনিত বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হবে। আবার বাণিজ্যসুবিধা কমে গেলে তা পুষিয়ে নিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশকে সপ্তম-পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা মাথায় রেখেই টেকসই অর্থনীতি ধরে রাখতে উত্তরণকালীন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
অনেক দেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে সমস্যায় পড়েছে। উদাহরণ দিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, যেসব দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি দেশও পাওয়া যাবে না, যাদের উদ্যোক্তা শ্রেণি আছে এবং একটি সক্রিয় শ্রমশক্তি আছে। যেমন মালদ্বীপ শুধু পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশ।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, এ অর্জন বাংলাদেশের জন্য গর্বের, সামনের দিনগুলোয় সামাজিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বহাল রাখা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের সামনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এটাই শেষ না। আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিক, সেই সঙ্গে ভয়ও পাচ্ছি। কেননা সমাজে ক্রমে বৈষম্য বাড়ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অর্থনীতিতে এগিয়ে নিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উৎপাদন ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বাড়াতে হবে। নতুন শিল্পায়ণ ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। সবচেয়ে জরুরি সুশাসন নিশ্চিত করা। না হলে সুযোগ ব্যাহত হবে।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, আমরা এমন একসময়ে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছি, যখন অনিশ্চয়তা আছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের আঘাত পড়বে।
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় বাজারসুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তব্য দেন ইউএনডিপির আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত চারলোটা স্কালাইটার।
বিশ্বজুড়ে ৪৮টি দেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এশিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে তালিকায় রয়েছে আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল ও ইয়েমেন।
সৌজন্যে: মানবজমিন
মন্তব্য করুন