নাম - ছবি : সংগ্রহীত
যুগের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে, মানুষের জীবন-যাপন প্রকৃতির পরিবর্তনে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে দ্রুত বাড়ছে ছোট পরিবার। সংসারে সচ্ছলতার প্রয়োজনে বাবা-মা দুজনেই চাকুরী কিংবা কাজ করছে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে। মূলত: একাকী শিশুর সমস্যার শুরু এখান থেকেই।
নাগরিক জীবনে এই বাস্তবতায় দিনের এক দীর্ঘ সময় বাবা-মার সান্নিধ্য বঞ্চিত হচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। দুরন্তময় শৈশবের কোন উচ্ছ্বলতা নয়, একাকীত্বকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠছে এই শিশু-কিশোরেরা। একাকী শিশুর সমস্যা অনেক। একাকীত্ব, মানসিক কষ্ট এসব শুধু বড়দেরই নয়, শিশুদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অতিরিক্ত পড়াশোনা, খেলাধুলার অভাব, বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা শিশুদের উপরেও প্রভাব ফেলে এবং একাকীত্বে ভোগে। মানসিক চাপের মধ্যে বড় হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শৈশবের এই ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের গোটা জীবনটাই নষ্ট করে দিতে পারে।
শিশুদের মানসিক চাপ, একাকীত্ব থেকে মুক্তির পথ জানালেন গবেষকরা। তারা জানান, শিশুদের মন ভালো রাখার একটি উপায় হল গান শোনা। গান শুনলে মন অনেক সময় ভালো থাকে। মনের আবেগও প্রকাশিত হয়। আবেগ মনের মধ্যে চেপে রাখলে তা মস্তিষ্কের ক্ষতি করে থাকে।
একাকীত্ব প্রসঙ্গে কয়েকজন শিশু-কিশোর জানায়, যখন তাদের বাবা-মা কাছে থাকে না তখন খুব খারাপ লাগে; তাদের ইচ্ছে করে বাবা-মায়ের সাথে বেশি সময় কাটাতে। বাসায় থাকলে তারা সারা দিন টিভি দেখে আর না হয় কম্পিউটারে গেমস খেলে। কিন্তু এসব সবসময় তাদের ভালো লাগে না। সব সময় ইচ্ছে করে মায়ের সঙ্গে থাকতে। একা একা তাদের খুব খারাপ লাগে। মা-বাবা দু’জনেই চাকরিজীবী হলে সন্তানেরা মা-বাবার পরিচর্যা তেমন পায় না। ফলে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
শিশুদের বেড়ে উঠার পরিবেশ এবং জীবনাচার নিয়ে সম্প্রতি বেসরকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনি তথ্য। ঢাকার দুটি সরকারী এবং দুটি বেসরকারী বিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪৫১ জন শিক্ষার্থীর পরিচালিত এই সমীক্ষায় আরোও বলা হয়, ৭ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের বড় একটা শতাংশ একাকী থাকতে পছন্দ করে। সময়মতো খাবার খায় না ৭৪ শতাংশ। পড়ার টেবিল, বই খাতা গুছিয়ে রাখে না ২২ শতাংশ। দাঁত ব্রাশ করে না ৪ শতাংশ, শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করে না ৫৯ শতাংশ, কাপড়-চোপড় নিজে পরিস্কার করে না ৫৯ শতাংশ, মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে না ১৮ শতাংশ। সুতরাং জরিপ বলছে একাকী শিশুর সমস্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বর্তমানে অনেক নারী বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত আছেন। তাই ইচ্ছে থাকলেও তারা সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছেন না। কর্মজীবী মায়েরা শিশুদের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাছে রেখে যান। ফলে দীর্ঘ সময় শিশুটি গৃহকর্মীর সঙ্গে বাস করে। গৃহকর্মীর গুণগত মান কম হওয়ার ফলে শিশুটিরও গুণগত মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিশুদের পরিচর্যার অনিয়ম, নির্যাতন ঘটছে এই গৃহকর্মীদের দ্বারাই। আবার অনেক সময় দেখা যায়, গৃহকর্মীর সহায়তায় শিশু চুরির ঘটনাও ঘটছে। আর এর ফলে যারা বাসায় সন্তানকে একা বা পরিচারিকার কাছে রেখে যান, তিনি কর্মস্থলে গিয়েও কাজে মন দিতে পারেন না।
আর এই একা একা বড় হওয়া শিশুরাও বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভোগে। একক পরিবারের শিশুরা, যৌথ পরিবারের শিশুদের চেয়ে ভিন্ন মানসিকতার হয় এমনটাই বললেন একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি, একক পরিবারের বাচ্চারা কারও সঙ্গে মিশতে চায় না। বেশি মানুষ দেখলে ঘাবড়ে যায়। স্কুলে নিজের আনা টিফিন অন্যের সঙ্গে ভাগ করে খেতে পছন্দ করে না। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রায়ই দেখা যায়, শিশুরা খুব কাঁদে। কারণ, তারা একা একা বড় হয়ে অভ্যস্ত। একক পরিবারের এই শিশুরা শুরুতে স্কুলেও আসতে চায় না। কিন্তু কিছুদিন পরই ঠিক হয়ে যায়। এই শিশুদের খুব বেশি শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বও হয় না। তাদের এক বা দুজন বন্ধু থাকে। আর যৌথ পরিবারে বড় হওয়া শিশুরা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে। তারা অনেক মানুষের সঙ্গে মেশে। অন্যের সঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নিতে পছন্দ করে।’
বিশেজ্ঞদের মতে, শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগবে একাকীত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা শিশুরা। শিশুদের সময় যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তার আচরণগত সমস্যা দেখা দিবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিবে। একাকীত্ব, বিষন্নতা, উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ এবং অনেক সময় অস্বাভাবিক আচরণ, উত্তেজনাসহ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
(পাঠক কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত একান্তই পাঠকের, তার জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়)
সাবরিনা শুভ্রা
মন্তব্য করুন