ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছর হয়েছে । ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে গনপরিষদের অধিবেশনে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। গত ৪ নভেম্বর ২০২২ এ ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। যদিও সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছিল। তবে ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস হিসেবে পালিত হয়। অন্যান্য বছরের মত এ বছরও বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল দিবসটিকে ঘিরে নানা আয়োজন রেখেছিল। পত্র পত্রিকার পাতায় বেশ লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে।
এবছর ৩১ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় দিবসটিকে সরকারীভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সাধুবাদ প্রাপ্য। এবছর জাতীয় সংবিধান দিবসে সরকারীভাবেও কিছু আয়োজন ছিল তবে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। হয়তো আরো কিছু উদ্যোগ নিলে জনগণের মাঝে এ দিবসটি ঘিরে বেশ সাড়া জাগত। অনেক মানুষই সংবিধান সম্পর্কে জানতে পারতো কিংবা জানার আগ্রহ তৈরী হতো। আশা করি আগামী বছর গুলোতে আয়োজন সে চাহিদা পূরণ করবে।
সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রের চালিকা পদ্ধতির বর্ণনা সংবলিত লিখিত বিধান। সংবিধান সম্পর্কে জানা ও মানা নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য। যদি কোন নাগরিকের সংবিধান পাঠ না থাকে, তাহলে সে সংবিধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে কিভাবে? কিভাবে সংবিধান মেনে চলবে? একথা বলা যেতেই পারে যে গল্প, উপন্যাস ও কৌতুকের যত পাঠক আমাদের দেশে পাওয়া যাবে সংবিধানের তত পাঠক পাওয়া যাবে না। যারা সংবিধান সংশ্লিষ্ট নানা দায়িত্ব পালন করেন তারাও এ ব্যাপারে বেশ উদাসীন।
আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করেন , বিভিন্ন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন তারাও অনেকেই হয়তবা একবারও সংবিধান পাঠ শেষ করেন নি। অথচ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধান পাঠ থাকা দরকার। রাজনৈতিক দলের সদস্য ও নেতাদের তো রীতিমত অন্তরে গাঁথা থাকার কথা, চর্চা করার কথা। তবে তা না হওয়াটা হতাশাজনক। তবে আমরা হতাশ হতে চাই না, আগামী প্রজন্ম সংবিধান পাঠ করবে, চর্চা সমুন্নত রাখবে এটা আমাদের প্রত্যাশা।
গেল ৫০ বছরে সংবিধান সম্ভবত ৫ শতাংশ মানুষের হাতেও পৌঁছায়নি। তাহলে কি দাড়ালো? আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সংবিধান ও সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে জানেন না। তাই তারা মানতে পারেন না। সংবিধান প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নাগরিকের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা দরকার। শুধু পৌঁছালেই হবে না, সেই সাথে পাঠচক্রের আয়োজন করে অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রেডিও টেলিভিশনে সংবিধান নিয়ে আলোচনামূলক অনুষ্ঠান রাখা যেতে পারে। যে কোন পদ্ধতিতে হোক সংবিধান ও সাংবিধানিক পাঠ সহজলভ্য ভাবে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিকট পৌঁছানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে আইন ও আইনের শাসন বাস্তবায়ন সহজ হবে।
৫০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সংবিধান সংশোধন করা দোষের নয়, বরং যৌক্তিক। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমেয় হয় যে, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন হয়েছে ব্যক্তি, দল কিংবা বিশেষ অংশের মানুষের ইচ্ছা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে। যা কিছু সময় পর বুঝতে পেরে আবার বাতিল হয়েছে। তাই অপ্রয়োজনীয় সংশোধন থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
সংবিধান গৃহীত হবার ৫০ বছর পরেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা প্রাপ্ত হয় তা নানাভাবে বোঝা যায়। এটা অপ্রত্যাশিত! মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ ও সংবিধান পেয়েছি, সেখানেই যদি মুক্তি না থাকে, স্বাধীনতা, স্বাভাবিকতা না থাকে তা কি জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারবে? শাসন বিভাগের চাপ থেকে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
সংবিধানের পূর্ণ বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। ৫০ বছর কেটে গেলেও এ পর্যন্ত ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ হয় নি। যদিও ১৯৮০ সালে একটি আইন করা হয়েছিল, কিন্ত বাস্তবায়ন হয় নি। এ ব্যাপারেও রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের সদিচ্ছা থাকা দরকার। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটার মাধ্যম জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগন। তাই তাদের কর্তব্য হচ্ছে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। আর তারা যদি তা না হন বা জনমতকে প্রাধান্য না দেন বা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা না করেন তবে তারাও সংবিধান বর্ণিত দায়িত্বে অবহেলার জন্য দোষী বিবেচিত হবেন। তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হওয়ায় ভারতের সংবিধান যেভাবে শক্তিশালী হয়েছিল, পাকিস্তানের সংবিধান জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী না হওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পাকিস্তানের সংবিধান তৈরীতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়েছে এবং শাসক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাতিল হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে খুবই কম সময়ে, যুগোপযীভাবে এবং সংবিধান গৃহীত হবার পর কখনোই পুরোপুরি বাতিল হয়নি। যদিও কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছে, আংশিক রহিত হয়েছে, সংশোধিত হয়েছে। এটা একটা বড় অর্জন। যে সংবিধানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন যত বেশী হবে, সে সংবিধান তত বেশী কল্যাণকর ও স্থায়ী হবে।
সংবিধান একটি পবিত্র আমানত। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারে সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রকৃতপক্ষে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে।
লেখক: সংবিধান, সংসদ ও রাজনীতি গবেষক
ই-মেইল:asadnoorbd@yahoo.com
আসাদ নূর
মন্তব্য করুন