ছবি- সংগৃহীত
সব মানুষের একই প্রশ্ন, আমরা কোথায় যাচ্ছি! দেশে কি হচ্ছে! পত্রিকার পাতা উল্টালে, টেলিভিশনের পর্দায় তাকালে নানা প্রশ্নে ও কষ্টে বিবেকের কাছে আটকে যায়। আর পত্রিকার সংবাদগুলো চোখের সামনে আসে তখন মর্মস্পর্শী ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে যায়।
গত কয়েকদিন পত্রিকার প্রকাশিত যেসব হেডলাইনগুলো বিশেষভাবে দেখা যায় তার মধ্যে: `আমার মানিক কবে আসবে! আমার দেখার কেউ নেই, বাবু চলে গেল। আমার বাবা আমাকে না বলে চলে গেল। আমার বাবু আমাকে আর ওষুধ কিনে দেবে না। আমার সংসারের খোঁজ আর কেউ নিবে না।’ এভাবে নানা হৃদয়স্পর্শী শোকের মাতমে সন্তান হারা বাবা-মা মুর্ছা যাওয়া ও বর্ণনা আমরা প্রত্যেকদিন দেখতে পাচ্ছি। ছাত্র আন্দোলনে শুধু ছাত্ররা শাহাদাত বরণ করেনি, সাধারণ পথচারী, খেটে খাওয়া মানুষ, কর্মজীবিসহ সর্বশ্রেণীর মানুষ এ হত্যার শিকার হয়েছে। বাসা বাড়িতে অবস্থান করা শিশুরাও এ আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বাসার ছাদে থাকা ৬ বছরের রিয়া ঘোষ, বাসার বেলকুনিতে থাকা চার বছরের শিশু আহাদ, জানালার পাশে থাকা সামিরও বাদ যায়নি। গুলির আঘাতে এসব আদরের শিশু প্রাণ দিয়েছে। গুলির আঘাতে, বেদম প্রহারে, রডের আঘাতে, লাঠির গুতায় নানাভাবে শত শত মানুষের প্রাণ গিয়েছে। অনেক পরিবার নিদারুণ কষ্টে চলত একজনের আয় দিয়ে।
এমন স্বল্প আয়ের গরিব কর্মজীবিও আন্দোলনে শাহাদাত বরণ করেছে। পরিবারে একমাত্র পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থী যে আগামী দিনে সংসারের হাল ধরার জন্য যোগ্য হয়ে উঠেছিল এমন সম্ভাবনাময় মেধাবী তরুণরাও জীবন দিয়েছে। আন্দোলন এখনও উত্তাল বলা যায়। সরকার ও প্রশাসন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে বিষয়টি সমাধানের জন্য। সামগ্রিকভাবে দেশের যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা মানুষের মাঝে এক ধরনের আতংক-শঙ্কা ও ভয়ভীতি কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজিবি, আর্মি মাঠে ময়দানে সাজোয়া যানে যথেষ্ট তৎপর আছে সামাজিক স্থিতিশীল পরিবেশ আনার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে।
আসলে ব্যাপারটি অল্প সময়ের ব্যবধানে যেভাবে সাধারণ মানুষের হৃদয় আঘাত হেনেছে, তাতে সহজে শান্তি আনাটা কঠিন। কিন্তু দেশের মানুষ কেউ চায় না দেশে এমন অস্থির পরিবেশ বিরাজ করুক। সহিংস পরিবেশে সামাজিকভাবে নানা কারণে নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ শংকিত অভিভাবক ও সর্বশ্রেণীর মানুষ। দেশে এখনো কারফিউ জারি আছে।
সাধারণের চলাফেরার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা রকম বাধা। কর্মজীবি নিরীহ মানুষ সহজে চলাফেরা করতে পারছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিল্প কারখানা খুললেও তারা বাধার কারণে সেভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়নি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ ব্যবসায়ী ও অনলাইন বেষ্টিত যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে সেখানে মারাত্মক ধস নেমেছে। অর্থনীতি উন্নয়নে বড় রকম ধাক্কা ইতোমধ্যে অনুধাবন করেছে সমাজের সচেতন মানুষ। বাস্তবতার ক্ষেত্রে যে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশে এত অস্থিরতা ও দুর্বিসহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার একটি বিহীত সুরাহা করলেও আন্দোলন এখনও সমাপ্ত হয়নি। ছাত্রদের দাবি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম তুলে ধরা হয়েছে।
সর্বশেষ নয় দফা দাবীর মুখে সরকার ও প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী। যদি উল্লেখিত ৯ দফা সরকার না মানে, তাহলে পুনরায় রাজপথে আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু করার বিবৃতি ইতোমধ্যে দিয়েছে। একটি বিষয় বলা দরকার গতকাল ২৮-৭-২০২৪ ডিবি কার্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের পাঁচজন সমন্বয়ককে এক সভা করা হয়েছে। সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিজেদের তৈরি একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি অতি কৌশলে অন্যতম সমন্বয়কারী নাহিদকে পাঠ করাতে দেখা গেছে।
সেখানে বলা হয়েছে ‘আমরা সরকারের সকল নির্দেশনা মেনে নিয়েছি, এবং আমাদের রাজপথের আন্দোলনের সমাপ্ত করেছি।’ এ প্রেসবিজ্ঞপ্তি ডিবি হারুণের নেতৃত্বে অপকৌশলে ফাঁদে ফেলে সমন্বয়কারী পাঁচ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে পাঠ করানো হয়েছে। যা উদ্দেশ্যে প্রোনোদিত ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ন্যায় অপকৌশল মাত্র। রাতেই অন্যছাত্রদের দ্বারা এ তথ্য গণমাধ্যমে সত্যতা তুলে ধরে তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে ছাত্রদের পক্ষথেকে জানানো হয়েছে। দেশে যদি এভাবে পাল্টাপাল্টি তথ্য বিভ্রাট করে আরো অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়, তাহলে শান্তীকামী সাধারন মানুষ যাবে কোথায়। আমরা দেখি দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদরা কি নির্দেশনা ও সরকারের কার্যক্রম নীতিগত কি ভাবছে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টকশোতে নানান জনে নানান মতামত ও পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্যানার ও মুক্তচিন্তার আলোকে তারা দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে বহু পরামর্শ ও সমালোচনাও করেছেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও বিবৃতি এসেছে। তবে সমাজকর্মী রেজোয়ানা, ফারজানা শারমীন পুতুল, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ডক্টর আসিফ নজরুল, সাবেক সংসদ সদস্য বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নুরুল করিমসহ দেশের বিশিষ্টজন বর্তমান দেশের যে আন্দোলন কেন্দ্রিক সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী খুন ও আর্থিক ক্ষতিসহ অস্থির পরিবেশ নিয়ে মতামত ও সমালোচনা করেছেন। তাতে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ চালালো প্রশাসন কেন অবহিত নন। আর প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ও দলীয়ভাবে ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিমূলক বক্তব্য ছাত্রলীগকে যথেষ্ট সংঘাতের মুখোমুখি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন।
এর পাশাপাশি কোটার ব্যাপারে অ্যাকাডেমিক একটা বিষয় রয়েছে যা রাজনৈতিকভাবে কোন মন্ত্রীদের উপর দায়িত্ব না দিয়ে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন শিক্ষককে সমাধানের জন্য কমিটি করা হতো, তাহলে অতি সহজে সমাধান হতো। মূলত ছাত্রদের বিষয়গুলো শিক্ষকরা যথেষ্ট ছিল। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ। এতগুলো মানুষের অকাতরে জীবন দেয়ার ব্যাপারটা আরো গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল। আলোচনায় বক্তারা আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল এদেশের ছাত্র আন্দোলন আজ নতুন নয়।
কিন্তু যৌক্তিক ন্যায্য দাবিকে প্রশাসনের কাছে তুলে ধরা কোন অন্যায় নয়। মাঠে ময়দানে আন্দোলন হল, স্লোগান হলো অথচ নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিত গুলি করতে হবে এমন নির্দেশনা কেন দেয়া হলো। যখনই ছাত্ররা দিশাহীন হয়েছে, তখন দেশের সম্পদের উপর চড়া হয়েই আক্রমণ করেছে। কিন্তু সেখানেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা ছাত্রদের থামানোর যে প্রক্রিয়া ছিল, সে ব্যাপারে কোন ভূমিকা নেয়া হয়নি। এভাবে নানা মন্তব্যের ধারা বিভিন্ন টকশোতে এখনও অব্যাহত আছে।
যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি সাধন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের লাশ হতে দেয়া এবং দেশের অনাগত প্রজন্মকে শেষ করা। কোন কোন পরিবারের একেবারে বসে যাবে। কয়েকজন বাবা-মা, ও বউ সন্তান ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়ে আগের মতো গ্রামে সেই কষ্টের জীবনে চলে যেতে শুরু করেছেন। যদিও শহীদ আবু সাঈদসহ ৩৪টি পরিবারকে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সমবেদনা ও আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। যেটা দেশের জন্য, মানুষের জন্য বেশ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বর্তমান দেশজাতি ও সংঘাত সংশয়কে নিয়ে আরো কিছু কলামিস্ট স্বাধীন মতামত পেশ করেছেন: যেমন গত ২২ জুলাই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত “অস্থির সময় থেকে মুক্তি আসবে কবে শীর্ষক নিবন্ধে জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন- “কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের প্রথম কয়েক দিনের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত উক্তিকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হলো। মধ্যরাতে হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করল।এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিলেন। এরপরই আমরা দেখলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল। পিটিয়ে ছাত্রদের আহত করল। এখনকার ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র নয়। তারা অনেকে জোর করে ক্যানটিনে খায়, তারা রুম দখল করে রাখে। সাধারণ ছাত্রদের গণরুম নামের একটা জেলখানায় থাকতে বাধ্য করে। মিছিল–মিটিংয়ে না গেলে পেটায়। এগুলো তো বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। কোটা সংস্কার তো একটা উপলক্ষ, ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণেই আন্দোলনটা এত বড় হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই ছাত্ররা বেরিয়ে এল। হেলমেট বাহিনী তাদের পেটাল। আন্দোলন ক্যাম্পাসের বাইরে চলে এল।
আন্দোলন যাঁরা করছিলেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তো লুঙ্গি পরে, তারা এখানে শামিল হয়েছে। রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, দোকানদার, পরিবহনশ্রমিক—সব ধরনের লোকই আন্দোলনে নেমে গেছেন। এখন আর আন্দোলনটা ছাত্রদের হাতে নেই। মহিউদ্দীন আহমেদ আরো উল্লেখ করেছেন- আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচার কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ছুড়েছে, গুলি করেছে। গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড—এগুলো কাদের টাকায় কেনা? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সেগুলো কেনা। আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই কথা, ‘আমার জনগণের টাকায় অস্ত্র কেনা হয়, সেই অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, আমার জনগণের বুকের ওপরে?’ আন্দোলনের কয়েকদিনে নির্বিচার গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন- “সরকার যদি আক্রমণাত্মক ভূমিকা থেকে সরে না আসে তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।”
এভাবে দেশের বর্তমান অবস্থা নিরসনের ক্ষেত্রে মনের কষ্টের কথা ও বুদ্ধিজীবী লেখকরা মন্তব্য ও পর্যালোচনামূলক নির্দেশনা দিয়েছেন- ২৭ জুলাই দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত- “বল প্রয়োগের আত্মঘাতী পথ পরিহার করা জরুরী” নিবন্ধে বিশিষ্ট বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী জনাব বদিউল আলম মজুমদার লিখেছেন- “দুর্ভাগ্যবশত গত ১৫ বছরে সরকারের কার্যক্রম ছিল এসব অঙ্গীকারের সম্পূর্ণ বিপরীতে। বছর দুয়েকের মধ্যেই পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে আফসোস করে বলতে শোনা গিয়েছিল যে দেশটা বর্তমানে ‘বাজিকরদের’ হাতে। তিনি আরো লিখেছেন- “আমরা দেখতে পেলাম সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও প্রতিবাদী কণ্ঠের দমন–পীড়ন সীমা ছাড়িয়েছে। আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ফলে অনেক নাগরিকই তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং আমাদের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে পড়েছে। ক্রনিজম, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, অর্থ পাচার এবং মুদ্রাস্ফীতি বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হওয়া নাগরিকদের কেউ কেউ ছাত্রদের আন্দোলনে শামিল হওয়াই স্বাভাবিক।”
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশের আরো কয়েকটি পত্রিকার মন্তব্য প্রতিবেদন এবং পর্যালোচনা ও সমালোচনা করেছেন লেখক, গবেষকগণ। দৈনিক নয়া দিগন্তের গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত এক নিবন্ধে কবি আব্দুল হাই সিকদার বলেছেন— “এবার যেন আগুনে ঘি পড়ল। আন্দোলন আর শান্তিপূর্ণ অহিংস থাকল না। একদিকে হামলা অন্যদিকে চলল প্রতিরোধ। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত ও গণতন্ত্রমঞ্চসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল এই আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও দেশের মানুষকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানায়। সে কারণে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুরো আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
দেশের অবস্থা যাই হোক তাই থাক এখন অস্থিতিশীল আসাটা সময়ের অনিবার্য দাবী। কারণ এদেশে একের পর এক অর্থনৈতিক সংকটও আসছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে দেশের সবপর্যায়ে সকলকে এ সংকটের শিকার হতে হবে। এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া দরকার সকলকে ঐক্যভাবে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কাজ করা প্রয়োজন। গতকয়েকদিনে সহিংস সংঘাতে দেশের জিডিপি অনেক পিছিয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে লেখক ও কলামিস্ট ২৭ জুলাই দৈনিক নয়া দিগন্তে একটি সমীক্ষা ও পর্যালোচনা মন্তব্য প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন-
“অবস্থাদৃষ্টে এখন হত্যা ও মৃত্যুর বিষয়টি উহ্য রেখে ক্ষয়ক্ষতি জানান দেয়ার এক মৌসুম চলছে। তা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টদের প্রতিটি খাত থেকে আসছে ক্ষতির ভয়ঙ্কর তথ্য ও চিত্র। শুধু রফতানিমুখী তৈরী পোশাক, বিমান পরিবহন, স্টিল, সিরামিক, সিমেন্ট ও ই-কমার্স খাতেই প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
১৮ জুলাই থেকে সহিংসতা শুরু হলে সে দিন রাতেই বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। এতে ইন্টারনেটনির্ভর সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই বন্ধ হয়ে যায়। সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে পরদিন রাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। সেই সাথে টানা ৩ দিন সাধারণ ছুটি। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের কলকারখানা ও যানবাহন চলাচল। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরী পোশাক শিল্প। এর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, তাদের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এই খাতের ক্ষতির অঙ্ক প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্টদের এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪২০ কোটি টাকা বলে দাবি । করোনার সময়ও এত ব্যাপক ক্ষতি হয়নি বলেও দাবি তাদের। স্টিল খাত থেকে দিনে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি করে ছয় দিনে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। ইন্টারনেট-সেবা না থাকায় বিমানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনসেবাও ব্যাহত হয়। সেখানে দিনে অন্তত ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি ধরে ছয় দিনে অন্তত ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতির অঙ্ক ঠিক করা হয়েছে। সিরামিক খাতে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি ধরে মোট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সিমেন্টও অর্থনীতির বড় খাত। এই খাতে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়ে থাকে। প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের চার্জ ৪৫ মার্কিন ডলার। এক দিনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাবদ বন্দরের আয় কমেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ও বাল্ক পণ্যেও প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে। ফলে প্রতিদিন বন্দরের আয় কমেছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। গত পাঁচ দিনে এই সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি টাকা হতে পারে। পাঁচ দিনে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। কিছু খাতের ফাইনাল হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সামনে হিসাবের অঙ্ক আরো অনেক গড়াবে, তা নমুনাই বলে দিচ্ছে। বিটিভিরই কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।”
সর্বোপরি বলা দরকার দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে দেশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে দেশকে বাচাতে। এদেশের মানুষকে তাদের অধিকার ও নূন্যতম নীতিগত পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মানসিকতা পরিহার করে সহমতের ভিত্তিতে দেশের মানুষের সহবস্থানে থাকা সময়ের একান্ত দাবী।
অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ
মন্তব্য করুন