প্রতিকী ছবি
দীর্ঘদিন ধরে চলমান সকল প্রকার বৈষম্য ও সামাজিক অনিয়ম-অবিচার ও অসাম্য দূর করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়গ্রহণ করার সময় এসেছে আজ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথমে কোটা-সংস্কার আন্দোলন হলেও পরবর্তীতে এটা দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে গত ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের টানা পনেরো বছরের শাসনামলের নিদারুণ পতন ঘটে। বর্তমানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য এখন রাষ্ট্র সংস্কার। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে।দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে এ ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে কেউ যাতে আর স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে,রষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে কেউ যেন আর শেখ হাসিনার মত ডাইনি হয়ে উঠতে না পারে এমন অনেকগুলো কারনেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিটি করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে মতবিনিময় করছেন এবং তাদের মতামত গ্রহন করছেন। দফায় দফায় বৈঠক চালিয়ে চাচ্ছেন ড.ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কতদিন সময় লাগবে তা নিয়ে অবশ্য বিএনপির সাথে অন্যান্য দলের কিছুটা মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বিএনপি সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়। যেটা অন্যরা চায়না।বিশেষ করে জামায়াতের বক্তব্য হলো রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দেয়া উচিত,কোন টাইমফ্রেম বেধে দেয়া ঠিক হবেনা।
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিএনপি ৩১ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছে।অ্রন্যদিকে জামায়াত ৪১ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে। অন্যান্য দলও তাদের প্রস্তাবনা লিখিত আকারে সরকারের কাছে পেশ করেছে।সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিসমুহ এসব প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে।সময় যাই লাগুক সংস্কার কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। আশা করা যায় যে,বর্তমান সরকার একটি সুন্দর আগামীর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব হলো:
১. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে।
২. বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
৩. সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হবে।
৪. পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
৫. বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে।
৬. আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে (দেখা হবে) বিবেচনা করা হবে।
৭. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।
৮. সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠান আইনি সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।
৯. বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন করা হবে। অধঃস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যাস্ত হবে (সংবিধানের ভাষা)। বিচারবিভাগের জন্য সুপ্রিমকোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত ইতোপূর্বেকার ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। এজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে কেবল জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নীতিবোধ, বিচারবোধ ও সুনামের কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করিয়া বিচারক নিয়োগ করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে।
১০. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিষেবা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি “প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন” গঠন করে প্রশাসন সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে। মেধা, সততা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
১১. গণমাধ্যমের পুর্নস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান ও সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি, মিডিয়া সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীএবং বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য মিডিয়া ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন করা হবে। সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই লক্ষ্যে সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সকল সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে।
১২. দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। গত দেড় দশকব্যাপী সংঘটিত অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশের বাইরে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে 'দুদকের' স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা হবে।
১৩. সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন করা হবে। সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে মানবাধিকার কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা হবে। গত দেড় দশক যাবত সংগঠিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।
১৪. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নিরিখে প্রবৃদ্ধির সুফল সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দুর করা হবে।
উপরোক্ত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, মিডিয়া কমিশন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশনগুলি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ব-স্ব প্রতিবেদন দাখিল করিবে যেন সংশ্লিষ্ট সুপারিসসমূহ দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
১৫. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করিবেন। দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি-গোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-কর্মের অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হইবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৬. মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে। শিশু-শ্রম বন্ধ করে তাদের জীবন বিকাশের উপযোগী পরিবেশ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ বন্ধ শিল্পকারখানা পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে বিমানবন্দরসহ সকল ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রাপ্তি ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হবে। চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওড়-বাওর ও মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৭. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ রোধ করার লক্ষ্যে জনস্বার্থবিরোধী কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনায় চলমান সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ করা হবে। আমদানিনির্ভরতা বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং উপেক্ষিত গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিল্পখাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সুযোগ ও প্রনোদনা দেওয়া হবে। পরিকল্পিতভাবে দেশব্যাপী সমন্বিত শিল্প অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে।
১৮. বৈদেশিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারপরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বি-পাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক সমস্যার সমাধান করা হবে। বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে রাজনৈতিক ঢাল বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সন্ত্রাসবাদের তকমা লাগিয়ে ভিন্নমতের বিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক বিরোধীদল দমনের অপতৎপরতা বন্ধ করা হলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে।
১৯. দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। স্বকীয় মর্যাদা বহাল রেখে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।
২০. ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। এই সব প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে যেন তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির খবরদারী মুক্ত স্বাধীন স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা হইবে। মৃত্যুজনিত কারণ কিংবা আদালতের আদেশে পদশূন্য না হইলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করা হবে না। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশবলে সাসপেন্ড/বরখাস্ত/অপসারণ করা হবে না।
২১. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হইবে। এই তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করিয়া একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে।
২২. যুবসমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হইবে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানামুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। যুব সমাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ আদায়ের লক্ষ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়া মানবসম্পন্ন উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা করা হবে।
২৩. জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। নারী ও শিশুদের জীবনমান বিকাশের নিমিত্তে যুপোপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হইবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
২৪. বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা-ভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হইবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হইবে। একই মানের শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্র সংসদে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে। যোগ্য, দক্ষ ও মানবিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যেজাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্টখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সকল খাতকে ঢেলে সাজানো হবে। শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উৎপাদানখাতে গবেষণা ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ক্রীড়া উন্নয়ন ও জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনৈতিক আকাশ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা হবে।
২৫. স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও ‘বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়’ এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের আদলে সর্বজনীন করা হবে।
২৬. স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে। দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধা বঞ্চিত হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো সম্প্রসারিত করা হবে।
২৭. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হইবে। পর্যায়ক্রমে সকল ইউনিয়নে কৃষিপণ্যের জন্য সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হইবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বীমা, পশু বীমা, মৎস্য বীমা এবং পোল্ট্রি বীমা চালু করা হবে। কৃষি জমির অকৃষি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হবে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন এবং গবেষণার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্ম-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এতদসংশ্লিষ্ট রফতানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
২৮. দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারা দেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। দেশের সমুদ্র বন্দর ও নৌবন্দর সমূহের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হইবে।
২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও ক্ষতি মোকাবিলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাধুনিক ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। নদী ও জলাশয় দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বন্যা ও খরা প্রতিরোধে খাল-নদী খনন পুনঃখনন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞান সম্মত জরিপ ও মজুদের ভিত্তিতে তা আহরণ এবং অর্থনৈতিক ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৩০. তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বক্ষেত্রে এর প্রয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মহাকাশ গবেষণা এবং আনবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগ সমৃদ্ধ করা হবে।
৩১. এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষি জমি নষ্ট না করে এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হইবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিত করা হবে।
জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবনা-
জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‘দেড় সহস্রাধিক’ প্রাণের বিনিময়ে ‘স্বৈরশাসক’ শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল ‘স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে’ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান খাতে সংস্কারের যেসব প্রস্তাব জামায়াত দিয়েছে, সেগুলো হল–
আইন ও বিচার
● উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
● বিচার বিভাগ থেকে দ্বৈত শাসন দূর করতে হবে।
● বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
● আইন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
● ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিদ্যমান আইগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও ‘গণমানুষের মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ’ আইন করতে হবে।
● ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ এবং সকল ‘কালো আইন’ বাতিল করতে হবে।
● বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে বিভাগীয় পর্যায়ে হাই কোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
● নিম্ন আদালতের যথাযথ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে।
● সকল ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
● দেওয়ানি মামলার জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং ফৌজদারি মামলাসমূহ সর্বোচ্চ ৩ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান করতে হবে।
সংসদ
● সংসদের প্রধান বিরোধীদল থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার মনোনীত করতে হবে।
● সংসদীয় বিরোধী দলীয় নেতার নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
● সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।
নির্বাচন
● জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
● সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে।
● নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রত্যাখ্যাত ইভিএম ভোটিং ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।
● কোনো সরকারি চাকরিজীবী তাদের চাকরি ছাড়ার কমপক্ষে ৩ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
● স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
● অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ২০০৮ সালে প্রবর্তিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রথা বাতিল করতে হবে।
● নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হবে।
● জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
● এনআইডি ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা
ক) পুলিশ বাহিনীর সংস্কার
● ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত পুলিশ আইন পরিবর্তন এবং পুলিশের জন্য একটি পলিসি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
● পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।
● নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তির সুপারিশের সুযোগ রাখা যাবে না তথা সর্বপ্রকার দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রভাব বা হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
● পুলিশ ট্রেনিং ম্যানুয়ালের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক অনুশাসন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
● পুলিশের মধ্যে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাতিল করতে হবে।
● রিমান্ড চলাকালে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আসামিপক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি এবং নারী আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের অভিভাবকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
● বিচার বিভাগীয় সদস্যদের দিয়ে পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকতে হবে।
● পুলিশের ডিউটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উন্নত করতে হবে।
● ‘পুলিশ আইন’ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করতে হবে।
খ) র্যাব সংস্কার
● র্যাব ও অন্যান্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।
● গত সাড়ে ১৫ বছর যারা র্যাবে কাজ করেছেন, তাদেরকে স্ব স্ব বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাদের পুনরায় র্যাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
● বিচারবহির্ভূত সকল প্রকার হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
● র্যাবের সামগ্রিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য সেল গঠন করতে হবে। কোনো র্যাব সদস্য আইনবহির্ভূত কোনো কাজে জড়িত হলে এই সেল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবে।
● মিডিয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন ও অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
গ) জনপ্রশাসন সংস্কার
● জনবল নিয়োগ, বদলি, পদায়নে তদবির, সুপারিশ ও দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
● যে কোনো চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ না করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
● সরকারি চাকরিতে আবেদন বিনামূল্যে করতে হবে।
● চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আগামী ২ বছরের জন্য ৩৫ বছর ও পরবর্তী বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩৩ বছর এবং অবসরের বয়সসীমা ৬২ বছর নির্ধারণ করতে হবে।
● চাকরির আবেদনে সকল ক্ষেত্রে বয়সসীমার বৈষম্য নিরসন করতে হবে।
● সকল সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি নিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা যাতে করে কেউ দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়। এ জন্য প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
● চাকরিতে বিরাজমান আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে হবে।
● বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি চাকরিতে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও দলীয় বিবেচনায় চাকরি পেয়েছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
দুর্নীতি
● দুর্নীতি দমন কমিশনে পরীক্ষিত সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।
● রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
● দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।
● বিগত সরকারের আমলে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
● মন্ত্রণালয়ভিত্তিক দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করতে হবে।
● দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনসংস্কার, জনবল ও পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।
● রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ দখলকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে।
সংবিধান সংস্কার
● রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে।
● একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
ক) শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাব
● ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চমাধ্যমিক হিসেবে বলবৎ রাখতে হবে। অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করে পূর্বের পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
● পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে।
● সকল শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী উপাদান বাদ দিতে হবে।
● সকল শ্রেণিতে নবী করিম (সা.) এর জীবনীসহ মহামানবদের জীবনী সংবলিত প্রবন্ধ সংযোজন করতে হবে।
● স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যমান স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে সরকারিকরণ করতে হবে।
● প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে কামিল মাদরাসাকে সরকারিকরণ করতে হবে।
● কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত করতে হবে।
● Department of Higher Education নামে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে।
● শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সকল ধারা তথা সাধারণ, আলিয়া, কওমীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
খ) সংস্কৃতি সংস্কার
● জাতির ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মূল্যবোধের আলোকে বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।
● জাতির ঐতিহাসিক দিনগুলোকে স্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিশেষ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
● নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো অশ্লীলতামুক্ত করতে হবে। নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন কন্টেন্টে বিভিন্ন ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামকে হেয় করা থেকে বিরত থাকার বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
● প্রাণীর মূর্তিনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ না করে দেশীয় প্রকৃতি, ঐতিহ্যকে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন-ভাস্কর্যে তুলে আনতে হবে।
● সকল গণমাধ্যমে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম প্রচার নিশ্চিত করতে হবে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক সংস্কার
● পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল গণতান্ত্রিক দেশের সাথে সাম্য ও নায্যতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
● জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানিবণ্টন চুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে।
● আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে।
● অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বিগত সরকারের আমলে সম্পাদিত সকল চুক্তি রিভিউ করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি রিভিউ কমিশন গঠন করতে হবে।
● বাংলাদেশকে আসিয়ান জোটভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
● শক্তিশালী সার্ক পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
● কোনো দেশের সাথে চুক্তি অথবা সমঝোতা চুক্তি হলে পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে সেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক উত্থাপন করে বিস্তারিত আলোচনা পূর্বক তা অনুমোদন করতে হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সংস্কার
● ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে (ইফাবা) রাষ্ট্রের কল্যাণে অর্থবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
● ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে স্বতন্ত্র সংস্থা বা দপ্তরে রূপান্তর করতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
● ইসলামিক মিশনকে সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
● হজ ব্যবস্থাপনার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
● হজ ও ওমরাহর খরচ কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
● ইসলামিক ফাউন্ডেশনে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে দেশের বরণ্যে আলেমগণ সম্পৃক্ত থাকবেন।
● বিতর্কিত সকল বই বাতিল ও প্রকাশনা বন্ধ করতে হবে।
● সকল ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
শহীদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন