ছবি: সংগৃহীত
যেকোনো দেশের কৃষ্টি-কালচার ও জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে এবং মানুষের সুরক্ষা ও প্রয়োজনের তাগিদে প্রচলিত আইন বা নীতিমালাসমূহ প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুরক্ষা বা প্রতিফলন ঘটায় আইন। তবে তা যদি দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের পরিপন্থী হয় তা তো আর সুরক্ষা নয়, বরং ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। তবে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেকোনো ধরনের সংস্কার হতে পারে এতে সবাই একমত হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু জনপদের বৃহৎ অংশের বিশ্বাস ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত করবে।
৩৬ জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষের মাঝে নতুন করে আশা জেগেছে। উঠেছে নানা সংস্কার প্রস্তাবনা। তবে জনগোষ্ঠীর আক্বিদা ও বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো প্রস্তাবনা সামনে আনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া কার্যত বিভেদ ছড়াবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জায়গায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চলছে। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নারী সংস্কার কমিশন বেশকিছু প্রস্তাবনা প্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে।
জমা দেয়া প্রস্তাবনার কয়েকটি বিষয় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এসব সুপারিশ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস ও বোধের সাথে সাংঘর্ষিক। এর একটি হলো যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানে যৌনতাকে বৃত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাভিচারী নারী ও পুরুষের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে ইসলামের মতো অন্যকোনো ধর্মেও পতিতাবৃত্তিকে স্বীকৃতি তো দূরের কথা কোনো প্রকার সমর্থন দেওয়া হয়নি। যেখানে মানুষের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, সেখানে কিভাবে ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি মানুষের পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায়?
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তার মতে, নারী বিষয়ক কমিশন সার্বজনীন না করে সেকুলার শ্রেণির নারীদের দিয়ে গঠন করে একটা ক্যাচাল তৈরি করা হয়েছে। তার মতে, এটাই এই অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব; যা এই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে রাশেদ খান লিখেন, ‘কিয়েক্টা অবস্থা! যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সরকারের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন! বাংলাদেশের কোন ধর্মের মানুষই এটা এলাও করবে না। নারী বিষয়ক কমিশন সার্বজনীন না করে সেকুলার শ্রেণির নারীদের দিয়ে এমন কমিশন গঠন করে একটা ক্যাচাল তৈরি করা হয়েছে!’
তিনি আরও লিখেন, ‘বিবাহ বিচ্ছেদে, ভরণপোষণে তারা ধর্মীয় আইনের বিরোধিতা পর্যন্ত করেছে। নারী পুরুষের সমতা তারা চায়। আবার তারা নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের পক্ষে (প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন, যেখানে শুধু নারীদের বিপরীতে নারী প্রতিযোগিতা করতে পারবে)।’ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি লিখেছেন, ‘এই সরকারের মনোভাব ও চিন্তা ফুটে উঠেছে এই নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার মাধ্যমে! সংস্কারের নামে বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টাও কেউ কেউ করছে। আমার স্পষ্ট কথা, কোন ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো সংস্কার করা যাবে না।’
প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দেয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটি সংস্কার কমিশন বাতিল সহ পাঁচ দাবিতে মহাসমাবেশের ডাকও দিয়েছে। রোববার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশে (আইডিইবি)সংগঠনের আমির শাহ মহীবুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরি বৈঠক শেষে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন সংগঠনের মহাসচিব সাজিদুর রহমান।
পরে মহাসমাবেশের দাবিসমূহ তুলে ধরেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। আগামী ৩ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, নারী অধিকার সংস্কার কমিশনের তৈরি করা প্রস্তাবনায় অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান, বিশেষ করে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামী পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রস্তাবনাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করতে নিজের দাবি কথা জানান। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এই ধরনের বিতর্কিত, ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী, সরাসরি ইসলামবিরোধী, কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, ন্যক্কারজনক কটাক্ষপূর্ণ প্রস্তাবনা দেওয়ার কারণে এই কমিশন বাতিলের দাবি করছি। প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে এই প্রস্তাবনা প্রচারণা এবং সেটি এই সরকারের আমলে বাস্তবায়নের প্রত্যয় করা হয়েছে। আমরা এই ঘোষণা প্রত্যাহারেরও দাবি জানাচ্ছি। ’মামুনুল হক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যদি ৩ তারিখের আগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ঘোষণা প্রত্যাহার এবং নারী অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাকে প্রত্যাহার এবং ইসলামকে কটাক্ষপূর্ণ প্রস্তাবনা দেওয়ার দায়ে এই কমিশনকে বাতিল করা না হয় তাহলে ৩ মের মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলাম পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করবে।’
এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। রোববার দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালাকে সরাসরি কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের ওপর একটি সুপরিকল্পিত আঘাত। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে দেশের ধর্মীয় ভারসাম্য, পারিবারিক কাঠামো ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন মূলত আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত উত্তরাধিকার বিধান দ্বারা রচিত। এটিকে বাতিল করার অর্থ সরাসরি কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। এটি শুধু শরীয়তের অবমাননাই নয়, বরং মুসলিম পরিচয়ের মূলে কুঠারাঘাত বলেও উল্লেখ করে দলটি।
এছাড়াও ওলামা মাশায়েখ পরিষদও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাকে প্রত্যাখান করে বিবৃতি দিয়েছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। হাজার বছরের আকিদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা ও তাহজিব তামাদ্দুম সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুকুল সংস্কার প্রস্তাব তৈরির দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। তারা উল্লেখ করেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য সংস্কারের নামে সরাসরি কোরআন-সুন্নাহবিরোধী প্রস্তাবনা পেশ করার মতো স্পর্ধা দেখানো হয়েছে। তাদের দোসরদেরকে এখনই স্তব্ধ করারও দাবি জানায় আলেমরা।
নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের নিয়েও শুরু হয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। কারণ কমিশনের কোনো সদস্যই দেশের অধিকাংশ নাগরিকর ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসকে ধারণ করে এই প্রস্তাবনা তৈরি করেন। তারা প্রত্যেকে সেক্যুলার চিন্তার অধিকারী। ফলে তাদের সুপারিশগুলো দেশের নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার বিপক্ষে তৈরি করেছেন। যৌক্তিকভাবে একটি বিষয় পর্যালোচনার দাবি রাখে-তাহলো যৌনকর্মী বলে যারা স্বীকৃতি চান বা যে গোষ্ঠীটি চাচ্ছেন তাদের বিকল্প কর্মের সুযোগ নেই দেশে? লাখ লাখ নারী পোশাকখাতে কাজ করছেন। এরকম তো আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। কেনই বা ব্যাভিচারকে স্বীকৃতি দিতে মরিয়া গোষ্ঠীটি। সরকার কী সেক্যুলার নারীবাদীদের খপ্পড়ে পড়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করবে? হাজারো প্রাণের বিনিময়ে ২৪’র অভ্যুত্থানকে অসম্মান করবে? সময় আছে ভেবে দেখার। দেশের জনগণ রুষ্ট হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নিলে অস্থিতিশীলতা থেকে দেশকে নিরাপদ করা যাবে হয়তো। সর্বজন নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধতার প্রয়াস হীনতা ও ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা স্টেকহোল্ডার এটিকে সমর্থন হয়তো করবেন না। কিন্তু জিনিসটি উত্থাপন করাই একটি ষড়যন্ত্র বলেই আপাতত ধরে নিচ্ছেন অনেক বিশ্লেষক।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে প্রস্তাবনা তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন শিরীন পারভিন হক। কমিশনের সদস্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
এম এ জিসান
মন্তব্য করুন