• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
ব্রেকিং নিউজ
সর্বশেষ নিউজ
* পাকিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময়, নিহত ৬ * ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠক শুরু * রোমে বাংলাদেশ হাউস পরিদর্শন করলেন প্রধান উপদেষ্টা * রাঙ্গামাটিতে সিএনজি-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ৫ * সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে মেধাসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে * সমালোচনা কখনো অসভ্য ভাষায় হওয়া উচিত নয়: রেজাউল করিম * পোপ ফ্রান্সিসের অন্তিম যাত্রা আজ * ভুলে নিজ দেশের স্থাপনায় বিমান হামলা চালালো ভারত * হৃদয়কে আবারও শাস্তি দেওয়ায় তামিমের ক্ষোভ * ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে পুতিন-উইটকফ বৈঠক

উপমহাদেশ

ওয়াক্ফ আইন সংশোধনীতে বৈষম্য ও ভারতীয় সংবিধান

news-details

সংগৃহীত


সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের পার্লামেন্টে ওয়াক্ফ্ সংশোধনী বিল পাশ হয়েছে। অবশ্য কোন আইন হালনাগাদকরণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য উদ্দেশ্য মহৎ স্বচ্ছ হওয়া জরুরি এবং তা আইন, বিধান, রাষ্ট্রীয় সংবিধান এবং মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত রেখেই তা করতে হবে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোন আইন প্রণীত হলে বরং সংবিধানের মৌলিক বিধান ক্ষুণ্ন করে কোন আইন প্রণীত হলে তা গণনিগ্রহের কারণ হতে পারে। আর তা যদি বিশেষগোষ্ঠী বা শ্রেণিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় তা হবে আরো ভয়াবহ। যেমনটি হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বিদ্যমান ওয়াক্ফ্ আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে। যা দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার হরণের মোক্ষম অনুষঙ্গ হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সংবিধান আইন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য সরকার সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, আইন প্রণয়ন সংশোধনের ক্ষমতা আইন সভার রয়েছে। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন সভার ক্ষমতা শর্তহীন নয় বরং আইন সংবিধানের বৃত্তে বৃত্তাবদ্ধ। কারণ, আইন সভায় রেজুলেশন করে কাউকে প্রাণদণ্ড দেওয়া যায় না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াক্ফ্ আইন সংশোধন করতে গিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ১৪, ২৫ ২৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সামাজিক মৌলিক অধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন করা হয়েছে। ছাড়াও আরো কতিপয় অনুচ্ছেদের সাথে সংশোধনী রীতিমত সাংঘর্ষিক। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ (Article 25)-এর ভাষ্যমতে, প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর ধর্ম বিশ্বাস সংরক্ষণ, প্রকাশ পালন করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। মূলত, ওয়াকফ হল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি পবিত্র দাতব্য প্রতিষ্ঠান। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা স্বেচ্ছায় বিশ্বাসের ভিত্তিতে ওয়াকফ করে থাকেন। তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ সেটি ব্যক্তিগত ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হবে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ (Article 26) অনুযায়ী, প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন, পরিচালনা পরিচালনার অধিকার রাখে। ওয়াকফ বোর্ড সাংবিধানিক অধিকারের অন্তর্গত। কিন্তু ভারতীয় সরকারের পাশকৃত পরিবর্তন এমন স্বশাসনের নীতি খর্ব করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অনুচ্ছেদ ১৪ ১৫ (Article 14 & 15) সব নাগরিকের জন্য সমতা (equality before law) এবং বৈষম্যহীনতা (non-discrimination) নিশ্চিত করে। কিন্তু ভারত সরকার শুধুমাত্র মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নজরদারির নামে আইন প্রণয়ন করেছে, অথচ হিন্দু, খ্রিষ্টান বা শিখদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সে মানদণ্ড প্রয়োগ না করে অসাংবিধানিক বৈষম্য এবং বিশেষ একটি ধর্ম ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধ্বংসের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। সর্বোপরি ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় (Preamble) ‘ধর্মনিরপেক্ষতাএকটি মূল স্তম্ভ। রাষ্ট্র কোনও ধর্মকে প্রাধান্য দেবে না বা কোনও ধর্মকে দমন করবে না এমন চেতনার পরিপন্থী সদ্য পাস হওয়া সংশোধনী আইন। যা দেশটির অসাম্প্রদায়িক আত্মসচেতন মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। যা আইন সভার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না বলে জানাচ্ছেন আইনজ্ঞরা।

মূলত, সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সম্প্রতি ভারতের লোক সভায় মুসলিম ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। বিলের উত্থাপক সমর্থকরা বিলকে মহতি উদ্দেশ্যে আইন বিধানকে হালনাগাদ, ইনসাফপূর্ণ গণমুখী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিলটি আদ্যপান্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাসকৃত বিলটি সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্যায় অনায্য আচরণ করার জন্য হীন উদ্দেশ্যে প্রণীত পাস করা হয়েছে। আইনে যেভাবে ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে, তাতে জনকল্যাণ বা মহতি উদ্দেশ্যে ওয়াকফকৃত সম্পতি এক সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের পুরোপুরি হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, দলিল-দস্তাবেজ না থাকার বাহানা তুলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকারের খাস সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ শত শত বছর ধরে এসব ওয়াক্ফ্ সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃত এবং জনকল্যাণ মহতি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বস্তুত, ভারতীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর যে মুসলিম ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি পাস করেছে, তারপর দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত কোটি ডলার মূল্যের ওয়াক্ফ্ সম্পত্তি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করা হবে, তার পুরো পদ্ধতিটাই এখন বদলে গিয়েছে। বিলটি পাস হওয়ার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন মুসলিমরা এবং তারা প্রত্যাহারের জন্য রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছেন। পশ্চিম বাংলা তো ইস্যুতে এখন উত্তাল। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা সংশোধনীতে তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। আমরা মূল আলোচনায় যাওয়ার আগেওয়াক্ফ্কী সে সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

বস্তুত, ওয়াকফ বা ওকফ হলো ইসলামী আইন শাস্ত্রে সাধারণত একটি ভূমি, ভবন বা সম্পদ, যা ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য রেখে দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্যে দান করা সম্পদ। ওয়াকফকৃত সম্পদ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ধরনের দানশীল ব্যক্তিরাওয়াকিফবা দাতা হিসাবে পরিচিত হয়। সুন্নাহ ইসলামী সংস্কৃতির রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় কাজের জন্য চিরস্থায়ীভাবে নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে উৎসর্গ করাই হচ্ছে ওয়াক্ফ্।

ওয়াক্ফ্ শব্দটির আক্ষরিক অর্থেবন্দীত্বএবং নিষিদ্ধকরণ বা কোনও জিনিসকে থামানো বা স্থির করা। ইমাম আবু হানিফা (রাহি.)-এর মতে, ওয়াকফের বৈধ অর্থ ওয়াকফের মালিকানাধীন একটি নির্দিষ্ট জিনিস এবং তার সম্পদকেদরিদ্রতা বা অন্যান্য ভাল বস্তুর দাতব্যতায়নিবেদিত করা। ইমাম আবু ইউসুফ ইমাম মুহাম্মদ (রহ)-এর মতে, ‘ওয়াকফ হলো নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে আল্লাহর মালিকানায় নিবেদিত করা। এর মাধ্যমে সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়। যে সম্পদ থেকে তিনি বা তার বংশধর কোনো মুনাফা ফিরে পেতে পারেন না।

উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, ওয়াক্ফ্ মুসলিম সম্প্রদায়ের মহৎ ব্যক্তিদের দ্বারা মুসলমানদের কল্যাণে নিবেদিত সম্পদ যার মালিকানা স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে মানুষের কল্যাণে হস্তান্তর করা হয় ওয়াকিফআর্ত-মানবতার কল্যাণে তা আল্লাহর রাহে মালিকানা স্থায়ীভাবে হস্তান্তর করেন। তাই এখানে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র কোনভাবেই হস্তক্ষেপ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন না। কিন্তু ভারত সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সচেতনভাবেই এখানে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে।

আরবি ভাষায়ওয়াকাফাশব্দটি থেকে এসেছেওয়াক্ফ্ যার অর্থ হল সম্পত্তির হাতবদল বা মালিকানা হস্তান্তর। যখন কোনো ব্যক্তি মুসলিম আইনের আওতায় ধর্মীয় বা দাতব্য কারণে তার সম্পত্তি দান করেন, তখন সেটাকেই বলে ওয়াকফ সম্পত্তি। এরমধ্যে মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, আশ্রয়কেন্দ্র বা শুধু জমি-সব কিছুই থাকতে পারে। যে কাজের জন্য সেটি দান করা হয়েছে, সেটি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার করা যায় না এবং এটি বিক্রি বা হাতবদল করারও কোন সুযোগ নেই। অন্যভাবে বললে, ভারতে হিন্দু সমাজের মধ্যে যেটাকেদেবোত্তর সম্পত্তিবলে গণ্য করা হয়, মুসলিম সমাজে মোটামুটি তারই অনুরূপ সংস্করণ হলো ওয়াকফ। বাংলাদেশেও ওয়াক্ফ্, পীরপাল দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে। এসব সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে সরকার বা অন্য কোন সংস্থার হস্তক্ষেপ থাকে না বা নেইও।

ভারতের লোকসভায় গত এপ্রিল এবং রাজ্য সভায় এপ্রিল উত্তপ্ত তর্কবিতর্কের পর মুসলিম ওয়াকফ (সংশোধনী)-২০২৫ বিলটি পাস হয়েছে। তারপর গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত কোটি ডলার মূল্যের যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ পরিচালনা করা হবে, তার পুরো পদ্ধতিটাই এখন বদলে গেছে। বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গত এপ্রিল দীর্ঘ বিতর্ক ভোটাভুটি গড়িয়েছে মাঝরাত পর্যন্ত। প্রধান বিরোধী দলগুলো বিলটির বিরোধিতায় একজোট হয়েও এর পাস হওয়া ঠেকাতে পারেনি, পরদিন এপ্রিল রাজ্যসভাতেও অনায়াসেই উতরে গেছে সরকারের আনা বিল। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এপ্রিল অতিদ্রুতার সাথে বিলটিতে তার সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন। ফলে এটি এখন ভারতের আইনে পরিণত হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে বিলটিকে চ্যালেঞ্জ করে অন্তত চারটি পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে, যেগুলো করেছেন এআইএমআইএম, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি বা আরজেডির মতো দলের নেতারা এবং অন্তত একটি সিভিল রাইটস গোষ্ঠী। তারা প্রত্যেকেই দাবি করছেন, বিলটি চূড়ান্ত অসাংবিধানিক এবং দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে।

এখন সুপ্রিম কোর্ট বিষয়ে কী অবস্থান নেয় এবং মামলাগুলো শুনানির জন্য গ্রহণ করে কি না, সেটাই দেখার। তবে খুববেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ থাকছে বলে মনে হয় না। কারণ, শ্রেণি বিশেষের বিশ্বাসকে ভিত্তি ধরেই তো ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদকে বলী দেওয়া হয়েছে।অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল বোর্ড’-সহ ভারতের মুসলিম সমাজের অসংখ্য সংগঠনও ঠিক একই যুক্তিতে বিলটির তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু সরকার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে, দেশে মুসলিমদের ওয়াক্ফ্ সম্পত্তির পরিচালনা পদ্ধতিকে স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত করে তুলতেই আইনটি প্রণয়ন করা দরকার ছিল। কিন্তু আইনটির চুলচেরা বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং বিশেষ সম্প্রদায়কে অধিকার বঞ্চিত করার জন্য সংশোধন করা হয়েছে। এমনটিই মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। এখন নতুন বিতর্কিত আইনটিকে নিয়ে সরকার বিরোধীপক্ষ ঠিক কী বলছে, আইনে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনায় ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং ভারতের বাইরে বাংলাদেশেও আইনটি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে- আমরা সে বিষয়টি নিয়েই এখন আলোচনার চেষ্টা করবো।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াক্ফ্ বিল পাস হওয়ার ঘটনাটিকে দেশের জন্যওয়াটারশেড মোমেন্টবা এক পালাবদলের মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেছেন। নিজস্ব এক্স হ্যান্ডলে তিনি পোস্ট করেছেন, যে পদ্ধতিতে এতোকাল ওয়াক্ফ্ বা মুসলিম সম্পত্তিগুলো পরিচালনা করা হতো, সেওয়াকফ সিস্টেমটাই দশকের পর দশক ধরে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার অভাবের সমার্থক হয়ে উঠেছিল!’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘পার্লামেন্টে যে আইনটি এখন পাস হলো তাতে স্বচ্ছতাই শুধু বাড়বে না, নাগরিকদের অধিকারও সুরক্ষিত হবে।তবে বিলটির নিন্দায় বিরোধী শিবিরইন্ডিয়াজোট শুধু একাট্টাই ছিল না, পার্লামেন্টেও প্রায় সব বিরোধী দলই বিলটির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তারা বিলটিকে বর্ণনা করেছে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করার জন্য শাসক দল বিজেপির আর একটি প্রচেষ্টা হিসেবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও মনে করিয়ে দিয়েছেন, লোকসভায় ভোটাভুটির সময় বিলটির পক্ষে যেখানে ২৮৮টি ভোট পড়েছে, সেখানে বিপক্ষেও কিন্তু ২৩২টি ভোট পড়েছে। সুতরাং পার্লামেন্টারিয়ানদের একটা বড় অংশই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। মল্লিকার্জুন খাড়গে এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘এটা থেকেই আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন বিরোধী দলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এই বিলটি আসলে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিলটির আগাগোড়া সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন অল ইন্ডিয়া মজলিস--ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের সভাপতি তথা হায়দরাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, যিনি এখন আইনটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরও শরণাপন্ন হয়েছেন ইতোমধ্যেই। পার্লামেন্টে পার্লামেন্টের বাইরে তিনি যুক্তি দিয়েছেন, বিলটির আসল উদ্দেশ্য মোটেও সংস্কার নয়-বরং সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে মুসলিমদের অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়ার নগ্ন ষড়যন্ত্র। ওয়াইসি বলেছেন, ‘কেন্দ্র রাজ্যস্তরের ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য যাতে অমুসলিম হতে পারেন, সে পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে বিল। এখন একই জিনিস কিন্তু হিন্দু বা জৈন এনডাওমেন্ট বোর্ডে অথবা শিখদের গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটিতে করার সুযোগ নেই। ফলে গোটা পদক্ষেপটাই অসাংবিধানিক মুসলিমবিরোধী।দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করেছেন বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি। উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী প্রায় ৩০ কোটি মুসলিমের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা বা কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এসব সম্পত্তি অতীতে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ১৯৯৫ সালের ওয়াক্ফ্ অ্যাক্ট অনুসারে, যাতে প্রতিটি রাজ্যস্তরে সম্পত্তিগুলোর পরিচালনার জন্য ওয়াকফ বোর্ড গঠনের কথা বলা আছে। বোর্ডগুলোতে থাকেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের মনোনীত প্রার্থীরা, মুসলিম আইনপ্রণেতারা (এমপি বা এমএলএ), স্টেট বার কাউন্সিলের সদস্যরা এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ম্যানেজার বা পরিচালকরা। গত বছরের আগস্ট মাসে ওয়াকফ আইনটি সংশোধন করার জন্য বিজেপি জোট সরকার পার্লামেন্টে একটি বিল আনে। সরকারের তখন বক্তব্য ছিল, ওয়াক্ফ্ প্রশাসনের আধুনিকীকরণ নিশ্চিত করতে এবং পদ্ধতিরআইনি ফাঁক-ফোকরগুলোবন্ধ করতেই বিলটির প্রস্তাবনা। কিন্তু ভারতের মুসলিম নেতারা বিরোধী দলগুলো তখন থেকেই বলে আসছে, মুসলিমদের সম্পত্তির ওপর সরকার যাতে আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে একমাত্র সে কারণেই এই সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে। এরপর বিলটিকে আরো যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিলটিতে সামান্য কিছু পরিবর্তন করে সে কমিটি ছাড়পত্র দেয়ার পর চলতি মাসে সেটি সভায় পেশ করা হয়।

নতুন ওয়াকফ আইনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো কোনটাকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হবে, সে সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেয়া! ঐতিহাসিকভাবে ভারতে বহু ভবন জমিজমা এতোকাল আইনগতভাবে বৈধ ওয়াকফ সম্পত্তি বলে স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে, যেগুলো হয়তো শুধু মুখের কথায় (ওরাল ডিক্লারেশন) বা সামাজিক রীতিনীতি মেনে দান করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সেগুলো বহুদিন ধরে একটানা মুসলিম সমাজ ব্যবহার করে আসছে। তাই তাদের ওয়াক্ফ্ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অসুবিধা হয়নি। এখন নতুন আইনে বলা হয়েছে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে দাবি করতে হলে সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডকে তার স্বপক্ষে বৈধ নথিপত্র জমা দিতে হবে। বিতর্কিত কেসগুলোতে-বিশেষ করে সে জমিটা যদি সরকারি মালিকানাধীনখাস জমিবলে দাবি থাকে- সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সরকারের ওপরেই ন্যস্ত থাকবে।

দ্বিতীয়ত, নতুন আইনে মুসলিম নন, এমন ব্যক্তিরাও ওয়াকফ বোর্ড ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবেন। তৃতীয়ত, এতোদিন ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিতর্কের ক্ষেত্রে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু নতুন আইনে বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে-যার অর্থ যে কোনো পক্ষ চাইলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। এছাড়া নতুন আইনে দেশের সব ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটিসেন্ট্রালাইজড রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমগঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে-আইনটি বলবৎ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সব বিদ্যমান ওয়াকফ সম্পত্তিকে ওই রেজিস্টারে নথিভুক্ত করাতে হবে। নতুন করে কোনো সম্পত্তিকে যদি ওয়াক্ফ্ হিসেবে নথিভুক্ত করাতে হয়, তাহলে সেটার জন্য আবেদনও সিস্টেমের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডের কাছে পেশ করতে হবে। কোনো ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে বা সমীক্ষা করানোর দরকার হলে তাতেও সরকারের ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে, বস্তুত তারা ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী হবে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় সংশোধনী বিল যে বিশেষ শ্রেণির মানুষের অধিকার হরণের জন্য সংবিধান লংঘন করে করা হয়েছে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। দাবি করা হচ্ছে যে, সরকার নতুন আইন প্রণয়ন বা কোন আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতেই পারে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, সরকারের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অবারিত নয় বরং তা আইন সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। সংসদ বা লোকসভা কোন মানুষ, শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মৌলিক বা সংবিধান লঙ্ঘন করে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। তাই বিষয়টি নতুন করে বিবেচনার দাবি রাখে।


সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

মন্তব্য করুন