ছবি-সংগৃহীত
১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তি। চীনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। চায়না অর্থনীতি এখন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বসেরার অবস্থানে যাওয়ার দৌড়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন লিন ২০১১ সালে বলেছিলেন, ২০১০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত চীন ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।
চীনের বর্তমান নেতৃত্ব অর্থনীতিকে আরো সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চীন তার বিশাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর মধ্য দিয়ে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় চীন রপ্তানি বাজার সংকুচিত করে সুবিশাল এশিয়া মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য প্রসারে প্রয়াস নিয়েছে। দেশটি তার মুদ্রা ইউয়ানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রায় রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা করেছে। ইউয়ান ইতিমধ্যে একটি আঞ্চলিক অর্থব্যবস্থার অংশ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আদলে ব্রিকস চীন একটি এশীয় ব্যাংক করার উদ্যোগ নিয়েছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এর সদস্যপদ লাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ভারতের একচ্ছত্র প্রভাব বলয়ের মধ্যে ছিলো। সম্প্রতি চীন কৌশলগত কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি জোরেশোরে জানান দিচ্ছে। চীন এরই মধ্যে এখানকার রাষ্ট্রগুলোর সাথে সফলভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। আর ওদিকে দিন দিন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত। এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছিল। তবে সাম্প্রতিককালে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলেও রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিশেষ করে গত ৮ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কে যে ধরণের পরিবর্তনের আশা করছিলেন বিশ্লেষকরা সেখানেও তেমন কোনো প্রভাব দেখেননি। বিশেষ করে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ ছিল ব্যাপক। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক ধরণের নীরবতা চীনকে কিছুটা হলেও হতাশ করেছে। বোদ্ধাদের মতে, ভারতের অনিচ্ছার কারণেই মূলত তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা গতি পায়নি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ।
তবে জুলাইয়ে বেইজিং সফরে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাত করেন এবং দুই নেতা তাদের আলোচনার বেশিরভাগই বিআরআই অর্থায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেন। অর্থনৈতিক ইস্যুতে ফোকাস করার পাশাপাশি, চীন বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষ করে "প্রতিরক্ষা শিল্প ও বাণিজ্য, প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি, নৌবাহিনীর জাহাজের পারস্পরিক পরিদর্শন এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে"।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও ঐতিহাসিকভাবে ভারত বড় ভাইসুলভ আচরণ করে আসছে। দেশগুলোর সব ব্যাপারেই খবরদারি এবং দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ভারত এমন কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে গুজরাল ডক্ট্রিন, ইন্দিরা ডক্ট্রিনে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন পুরো আমেরিকাকে নিজের এখতিয়ারে রাখতে চায় মনরো ডক্ট্রিনের ছায়ায়, ভারতের মনোভাবও তেমন আধিপত্যবাদী। স্বভাবতই ভারত এ অঞ্চলে নিজের স্বার্থেই চীনের মত অন্য কারো খবরদারি বরদাস্ত করবে না। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সাথে নিয়ে চীনকে মোকাবেলায় বিভিন্ন পলিসিও গ্রহণ করেছে যার মধ্যে ‘ফ্রি এন্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক (এফওআইপি)’ তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৪৯ সালে চেয়ারম্যান মাও জেডং এর নেতৃত্বে চীনে সমাজতন্ত্র কায়েম হওয়ার পর তার লক্ষ্য ছিলো দেশের মধ্যকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সব ক্ষেত্রে চীনকে স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ১৯৮০ এর দশকে চীন তার গৃহীত নীতিগুলোর ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন দেশের সাথে শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে দৃষ্টি দেয়। ২০১৩ সালে শি চিনপিং কর্তৃক ‘বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ এর ঘোষণা ছিল সবচেয়ে বড় চমক যেটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৬৫ টিরও অধিক দেশকে যুক্ত করবে এবং বিশ্বব্যাপী চীনা প্রভাব বৃদ্ধি করবে। এরই ধারাবাহিকতায় চীন অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি অন্য দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে। আফ্রিকাতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দিকেও হাত বাড়ায় এবং এটাই ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে যেমন চাণক্য কৌটিল্যের প্রভাব স্পষ্ট, তেমনি চীনও দার্শনিক কনফুসিয়াস ও সুন জুর নীতির প্রতি আস্থাশীল। দুই দেশই আয়তন ও জনসংখ্যায় বৃহৎ এবং তাদের রয়েছে হাজার বছরের আলাদা আলাদা সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। সমাজতান্ত্রিক চীনের সাথে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবাধীন ভারত সম্পর্কোন্নয়নে ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ স্লোগানের সূচনা করে। ১৯৬২ তে ঘটে যাওয়া ইন্দো-চীন যুদ্ধ দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। উল্লেখ্য সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা আরো আগে থেকে বিরাজ করছিলো তাদের মধ্যে। এরপরে ‘৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ এ অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই বদলে দেয় যখন ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাশ্মীরের একটি নির্দিষ্ট এলাকা চীনকে দিয়ে দেয়। চীনের বিআরআই বাস্তবায়ণে এই অঞ্চলটি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানেই আছে ‘চীন-পাকিস্তান ইকনোমিক করিডোর (সিপিইসি)’।
২০১৩ সালের পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে চীন সম্পর্ক জোরদারে আগের তুলনায় বেশি মনোযোগ দেয় এবং এক্ষেত্রে তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করে চীন সরকার প্রদত্ত আর্থিক সহায়তা। একইসাথে ভারত মহাসাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। এতে পাকিস্তানের গোয়াদার পোর্ট এবং শ্রীলংকার হাম্বানটোটা পোর্টের সমস্ত সুবিধাই গ্রহণ করে চীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুটো বন্দরই চীনা অর্থায়নে নির্মিত এবং বিআরআই এর অংশ। পাকিস্তান-ভারত বৈরিতার সুযোগে চীনা-পাক সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই বিশ্বস্ততার সুতোয় গাঁথা। এদিকে ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র দেশগুলোও এর সাথে সম্পর্কের তিক্ততা এবং নিজেদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ‘পাপেট গভমেন্ট’ তথা ‘পুতুল সরকার স্থাপন করে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, আফগানিস্তান ও ভুটানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীন-ভারত রাজনৈতিক কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। অনেক জলঘোলার পরে ভারত চীনের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। আদতে তারা চীনা অর্থের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে চীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হলেও বাংলাদেশকে কাছে টানতে এত দিন শুধু অর্থনৈতিক সহায়তারই আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের পরীক্ষিত মিত্র এমন কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকায়। চীন প্রকাশ্যে মাথা ঘামায়নি বিষয়টি নিয়ে কারণ অর্থনৈতিকভাবে ঠিকই বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলো দিন দিন। কংগ্রেসের পর ভারতের বিজেপি সরকারও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও তাদের মাঝে উদ্বেগের ছাপ ছিলো স্পষ্ট। ২০১৬ সালে চীন থেকে দুটো পুরনো সাবমেরিন কেনার পর সেটি সবার দৃষ্টিগোচর হয়। ভারত সরকার এরপর নানা অজুহাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং মন্ত্রীদের ভারত সফর বাতিল করে এবং বাংলাদেশকে চাপ দিতে থাকে ভারতের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করতে।
সীমান্তে হত্যা, অসম পানি বণ্টন চুক্তি, এনআরসি, জনগণের ভারত বিদ্বেষসহ নানা কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। গত বছর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে চীনা-বাংলাদেশ যৌথ অর্থায়নে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর অনিশ্চয়তার কথা উঠে এসেছে। অনেক প্রকল্পের অর্থই চীন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রদান করছে না। স্বভাবতই এসব কারণে অনেক চাপে ছিলো বাংলাদেশ সরকার। তাছাড়া ২০১৮ এর নির্বাচন, দেশের অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতিও দারুণ বিপাকে ফেলে। এর মধ্যে আবার করোনার হানা। পরিস্থিতি যখন টালমাটাল তখনই নতুন করে চীনা সহায়তার আশ্বাস। চীনের বাজারে নতুন করে আরও ৫,১৬১ টি বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। এবার অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রতি নজর চীনের।
ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশকে চার দিক থেকে ঘিরে আছে ভারত- যদি আমরা আন্দামান-নিকোবরে ভারতের সামরিক উপস্থিতির কথা বিবেচনা করি। স্বাধীন বৈদেশিক নীতি প্রণয়নে এটি এর জন্য একটি বাঁধা হলেও একুশ শতকের বাস্তবতায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে ফেলনা নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক রবার্ট কাপলানের ভাষ্যমতে এ শতাব্দীতে শক্তিধর দেশগুলো ভারত মহাসাগরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়বে। গত বিশ বছরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা সে ইঙ্গিতকে আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এ দিক বিবেচনায় কৌশলগত কারণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়া সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব তাই অনেক।
স্বাধীনতার আগ থেকেই আমেরিকার দৃষ্টি ছিল সেন্টমার্টিনের দিকে। সেখানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য অনেক কিছু তারা করেছে এবং সে তৎপরতা এখনও চলমান। এ জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এশিয়ার বৃহৎ দুই শক্তি চীন ও ভারতের জন্য হয়ে পড়বে অস্বস্তিকর। যুক্তরাষ্ট্র আপাতত চীনের আধিপত্য রুখতে বেশি সাহায্য নিচ্ছে ভারতের। সরাসরি নিজে কিছু করার চেয়ে ভারতকেই ব্যবহার করছে হাতিয়ার হিসেবে। এজন্য ভারতকে ছাড় দিচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে- কাশ্মীর সংকট, এনআরসি, সাম্প্রদায়িকতা, পরমাণু শক্তি বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি। তাছাড়া চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও ভারতকে সাথে নিয়ে আনজুস (ANZUS) ও কোয়াড (Quad) এর মত সম্মিলিত প্রচেষ্টা তো রয়েছেই।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নাই। এক সময়ের মিত্র দেশ পাকিস্তানের সাথে তাই এখন আমেরিকার দহরম-মহরম তলানিতে। পাকিস্তানও সুযোগ বুঝে চেপেছে চীনের কাঁধে। চির শত্রু ভারতের সাথে তার একাত্ম হওয়া অসম্ভব। নেপালও তার ওপর থেকে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটান, আফগানিস্তানের বেলায়ও একই রকম দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ভারত নিজেই যেখানে চীনা অর্থের জন্য হা করে থাকে, সেখানে প্রতিবেশী দেশকে কব্জায় রাখতে খুব বেশি কিছু করে উঠতে পারছে না। চীনের বিশাল অর্থনীতির কাছে বড় ভাইসুলভ আচরণ তাই নস্যি।
চীনের লক্ষ্য ২০৪৯ সালের ভিতরে অর্থনীতিতে বিশ্বের এক নম্বর দেশ হওয়া। সে পথে ইতোমধ্যে অনেক দূর সে এগিয়েছে। এর জন্য যা করা দরকার তা সে করতে প্রস্তুত। বিআরআইকে সফল করার জন্য জলপথ ও স্থলপথের নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য এটি দরকার। নচেৎ সারা দুনিয়ায় আটশোর বেশি ঘাঁটি থাকা আমেরিকার সাথে চীন পেরে উঠতে পারবে না। তাছাড়া পথের কাঁটা হিসেবে আমেরিকার অন্য সব সঙ্গী-সাথী তো আছেই।
চীন শুরতে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিলো তার এ কাজে অন্যতম সহায়তাকারী হিসেবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক কাজ তারা করলেও শেষ মুহূর্তে ভারতের চাপে শেষ করতে পারেনি। বাধা পেয়ে তারা মায়ানমারকে সাথে নিয়ে কার্য সম্পাদনে নেমে পড়ে। দেশি-বিদেশি অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ চীনকে দিলে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট বাংলাদেশকে পোহাতে হতো না। চীন এরই মধ্যে এ সংকট নিরসনে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সে মতের পক্ষেই রায় দিয়েছে।
চীনকে রুখতে ভারত বিকল্প অনেক প্রস্তাব করেছে যার মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে গঠিত ’বিবিআইএন’ নেটওয়ার্ক অন্যতম। দুদিকে চীন ও পাকিস্তানের মত শত্রুর সাথে সদা লড়াইয়ে ব্যস্ত ভারতের বাংলাদেশের মত একটি বন্ধু রাষ্ট্র প্রয়োজন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে। তাছাড়া সেভেন সিস্টার্সে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত ‘চিকেন নেক’- এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যেও বাংলাদেশকে পাশে দরকার এর। তাদের মনে সব সময় শঙ্কা কাজ করে যদি চীন-বাংলাদেশ এক হয়ে কিছু করে বসে। বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী দাবী করে গেছেন আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা ফিরে না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না। এ দাবীতে বাংলাদেশের কিছু মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব। ওদিকে এসব রাজ্যও আবার অনেক আগে থেকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ইতিহাস বলে, ভারতের আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী পদক্ষেপের কারণেই তারা স্বাধীনতা পাচ্ছে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারতের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে আংলাদেশের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ সে প্রশ্নকে সামনে রেখেই আলোচনা এতদূর গড়িয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে চায় এবং নিজেদের ন্যায্য অধিকার চায় পানি বণ্টনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন-কানুন মেনে। অন্ততঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মনোভাব এটাই। এর জন্য তারা আপাতভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী অনেকাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্য দেশগুলো যখন বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জাম দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছিল, তখন চীন এগিয়ে আসে। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রমতে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যবহৃত প্রায় ৭০ ভাগ সরঞ্জাম চীন থেকে ক্রয় করা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের সম্ভব কি না, কিংবা আদৌ এটি বাংলাদেশিদের জন্য সুফল বয়ে আনবে কি না?
বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মতো না। শুরুতেই বলা হয়েছে ভারত মহাসাগরে সামরিক ঘাঁটিকে আমলে নিলে এটি চারদিক দিয়েই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমারের সাথেও এর সম্পর্ক ভালো নয়। দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কের আরো অবনমন ঘটিয়েছে। সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় এবং সমুদ্রপথে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর পক্ষে চীনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভবপর হলেও বাংলাদেশের সে সুবিধা নেই। তাই বরাবরই এদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি বড় ’ফ্যাক্টর’। তার অপব্যবহারও ভারত করে আসছে শুরু থেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলিয়ে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবাই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই এখানে। চীনের স্বার্থ আছে বাংলাদেশকে সহায়তা করায়, তাই সে করছে। ভারতের স্বার্থ বাংলাদেশকে কব্জায় রাখা, স্বাধীনতার পর থেকে তাই সে করে আসার চেষ্টা করছে এবং অনেকাংশে সফলও। অনেক সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড় করে দেখেছে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি এদেশে প্রতিবেশী দেশটির ব্যাপক আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করেছে।
শ্রীলঙ্কায় চীনা ফোকাস প্রধানত দ্বীপের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের ভূ-কৌশলগত আকাঙ্খার জন্য সেখানে প্রভাব বিস্তারের দিকে। ২০১৯ সালের মে মাসে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি এবং শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপালা সিরিসেনার মধ্যে একটি বৈঠকের সময়, দুই নেতা ২০১৬ সালে জারি করা সর্বশেষ যৌথ বিবৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিআরআই প্রকল্পগুলির সাথে অগ্রগতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কলম্বোর বিআরআই ঋণ পরিশোধের বিনিময়ে, চীনারা ৯৯ বছরের লিজে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পেয়েছিল। হাম্বানটোটা ভূ-কৌশলগতভাবে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত, যা বেইজিংয়ের স্ট্রিং অফ পার্লসকে শক্তিশালী করে।
মালদ্বীপের সাথে চীনের সম্পর্ক বর্তমানে তুঙ্গে। মালদ্বীপের উন্নয়নের জন্য বিআরআই-এর ব্যবহার এবং সেইসাথে ভারতকে মোকাবেলা করার জন্য সেখানে চীনা প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু প্রবল ভারতবিরোধেী হিসেবে পরিচিত।
নেপালের রাজনীতিতে সব সময় দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের প্রভাব বা সক্রিয়তা ছিল। একসময় এই প্রভাব ভারতের অনেকখানি একতরফা ছিল এখন চীনা প্রভাব নেপালি রাজনীতিতে প্রবল হয়ে উঠেছে। এই প্রভাবের একটি কারণ, নেপাল একটি ল্যান্ডলকড দেশ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানেও ক্রমশ প্রভাব বাড়ছে চীনের।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমাগত আগ্রহ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে না, বরং তা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও সহায়ক হবে। বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার সামষ্টিক বিষয় ভারতকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে এতদঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রায়ই বজায় রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যার কারণে এই অঞ্চলের নীতিগুলো ভারতের স্বার্থে নির্ধারিত হয়। এ ধরনের একমুখী পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই নতুন নীতির বলিষ্ঠ উদ্যোগ ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবে।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মন্তব্য করুন