ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে এক রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। উদিত হয়েছে বাংলায় নতুন সূর্য। দেশ পুনরায় হয়েছে স্বাধীন। স্বৈরাচারী শাসকের কাছ থেকে দেশের সাধারণ জনগণ মুক্তি পেয়েছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন এক বাংলাদেশ দেখেছে বিশ্ব। গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তারা বাংলাদেশ শাসনের খোলসে শোষণ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করে। টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন শেখ হাসিনা। কিন্তু ২০১৪-২০১৮ এবং ২০২৪ সালের তিনটি নির্বাচন হয়েছিল প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্নীতিতে ভরপুর।
নির্বাচনগুলোর ফলাফল নিয়ে কারচুপির অভিযোগ ছিল। ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ উঠে। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন এবং অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়। রাতের অন্ধকারে কেন্দ্রগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
২০২৪ সালের নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতা ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, ভোটের নিম্ন হার এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশের নির্বাচন: বিতর্কিত ভোটে চতুর্থ মেয়াদে বিজয়ী হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'। নানা বিতর্কের পর ও আওয়ামীলীগ পূণরায় টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে এবং বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে পুনর্নিবাচিত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জনগণ বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ দলকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের এই শাসনকালে দুর্নীতি, চোরাকারবার, অবৈধ টাকা পাচার, আওয়ামী লীগের নেতাদের অপকর্ম ইত্যাদির ফলে দেশের অবস্থা এবং দেশের অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। যার থেকে পরিত্রাণ পেতে কাতর ছিল সাধারণ মানুষ।
অবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হয় এদেশের জনতা। এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল ২০১৮ সালের দিকেই। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সূচনা ঘটায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তুলেছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তৎকালীন সময়ে তাদের এই দাবিগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়। পরে একই বছর কোটাবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। ১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে সরকার।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পরপরই এই আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনটি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শুরু হয়। পরবর্তীতে এই আন্দোলন দেশের সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে। কিন্তু সরকার তাদের এই দাবিতে কর্ণপাত করে না। বরং তাদেরকে পরোক্ষভাবে রাজাকার বলে আখ্যায়িত করা হয়। সরকারের মন্ত্রীরা তাদেরকে কটুক্তি করে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরো তীব্র হয়।
আন্দোলনকারীদের দমাতে আওয়ামী মদদপুষ্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পুলিশ বাহিনী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। তাদের হামলাতে প্রাণ হারায় রংপুরের আবু সাঈদসহ আরো অনেক শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করলেও সরকার তা অগ্রাহ্য করে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন সাধারণ জনগণের মাঝেও ছড়িয়ে যায়। আপামর জনতা আন্দোলনে যোগদান করে। কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করে। এদিন রাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ঘোষণা করে যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে এবং ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বলা হয়। পরের দিন অর্থাৎ ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীরা সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করে। সরকার আন্দোলনকারীদের দমাতে এক পর্যায়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও আন্দোলন আরো তীব্র হয়। সরকারের কঠোর সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয় শিক্ষার্থীরা। প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে আন্দোলনে যোগদান করে আইনজীবী, শিক্ষকসহ দেশের বুদ্ধিজীবী মহল। সকলেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করে এবং অনেকেই প্রত্যক্ষ রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলনে যোগদান করে।
হত্যা, গণগ্রেফতার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বুধবার সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি পালন করে। সময়ের পরিক্রমায় আওয়ামী লীগের গদ্দি দুর্বল হতে থাকে। ১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে বেলা দেড়টার একটু পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারীদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও সমন্বয়কারীগণ তা প্রত্যাখান করে। এর পরের দিন থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা ধীরে ধীরে দেশত্যাগ করা শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা তখন লং মার্চের ঘোষণা দেন এবং এক দফা এক দাবি অর্থাৎ শেখ হাসিনার পতনের দাবি জানিয়ে ঢাকামুখী হতে থাকে। আন্দোলনকারীদের দমাতে না পেরে অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে যাত্রা করে এবং এর মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। জয়ী হয় ছাত্র-জনতা।
ভবিষ্যত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ইতিমধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ করছে শিক্ষার্থীরা। তাদেরকে সমর্থন করছে দেশের আমজনতা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের পরামর্শে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাজারে এসেছে স্বস্তির ছোঁয়া। সিন্ডিকেটমুক্ত বাজারে একদিনেই দাম কমেছে বিভিন্ন পণ্যের।
তথাপিও বিভিন্ন কুচক্রী মহল দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা এবং রাতের অন্ধকারে অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাদেরকে অতিদ্রুত দমনের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সচেতন করা জরুরি। সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আসীন করতে ছাত্র-জনতা সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলে একত্রিত হয়ে আওয়াজ তুলতে হবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব হওয়ার পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অতি আবশ্যক।
আনোয়ারুল ইসলাম
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আনোয়ারুল ইসলাম
মন্তব্য করুন