সংগৃহীত ছবি
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বিগত এক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের ইমরান খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, আফগানিস্তানের মার্কিন সমর্থিত সরকারের পতন, শ্রীলঙ্কায় তুমুল বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট গাতাবায়া রাজাপক্ষের দেশ ছেড়ে পলায়নের মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০১১ সালের আফ্রিকার দেশ মিশরে হোসনি মোবারকের পতন, তিউনিশয়ায় আরব বসন্তের মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু আমরা কোন গণতন্ত্র পেয়েছি, তার সুফল কতটুকু জনগণ পেয়েছে, স্থায়িত্ব কতটুকু হয়েছে, সময়োপযোগিতার সঙ্গে কতটুকু খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে, শাসন ব্যবস্থায় মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারগুলো কতটুকু সুরক্ষিত হয়েছে- তা নিয়ে আজ নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন প্রশ্নও অবান্তর নয় যে সেসময়ের বিপ্লবটি হাইজ্যাক হয়ে গেছে।
বিংশ শতাব্দীতেও সারা বিশ্বে বেশ কিছু বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের নজির রয়েছে বিগত আড়াই দশকে। আরব বসন্তের আঁতুড় ঘর তিউনিশিয়ায় আরব বসন্তের মৃত্যু হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যে কারণে দেশটিতে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসেনি। আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে কতৃত্ববাদ। একইভাবে মিশরে গণঅভ্যুত্থানের পর মুসলিম ব্রাদার হুড ক্ষমতায় আসলে অল্প সময়ের মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনী ক্যু করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি এই ক্যুতে নেতৃত্ব দেন। তবে তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের সরকারকে ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারী সেনাবাহিনীর একটি অংশ ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্রুত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
সবশেষ বাংলাদেশের ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়। শহীদ হন অন্তত ২ হাজার তরুণ ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। ৮ আগস্ট গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দুই ছাত্র সমন্বয়কসহ বিভিন্ন পেশা ও মতের মানুষ উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। পরে কয়েক দফায় বাড়ানো হয় উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর। উপদেষ্টাদের নিয়ে নানা সমালোচনাও রয়েছে। তাদের জীবনাচার, রাজনৈতিক দর্শন, বিপ্লবে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। এছাড়া অভ্যুত্থানে অবদান রাখা রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক দাবি দাওয়া, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন প্রচেষ্টা, জুলাই বিপ্লবে আহত ও নিহতদের পরিবারগুলোকে সহায়তা কার্যক্রম এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকারের উদ্যোগগুলো নিয়েও আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে। তবে যেকোনো যৌক্তিক সমালোচনা পথচলাকে কঠিন করলেও তা নির্ভুলতার দিকে ধাবিত করে। সরকার তা কতটুকু চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করতে পারবে তা দেখার বিষয়। এই সরকারের নিক্তি হচ্ছে জুলাই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের চেতনা। সেই জায়গা থেকে সংস্কার কার্যক্রম কতটুকু অগ্রসর হবে, শহীদ পরিবারগুলোর ভার কতটুকু বহন করবে তা এখন মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
সরকারে থাকা ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে ২৪’র চেতনাকে ধারণ করে সংস্কার কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার রূপরেখা ঘোষণা করতে পারে সরকার। তাহলে হয়তো ধোয়াশা কিছুটা কমবে। অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবের অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া তলানিতে যাওয়া ফ্যাসিস্টদের শক্তি সঞ্চয়ের সহায়ক হতে পারে- সেবিষয়ে সতর্ক থাকাটা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতি ও বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য কতটা রক্ষা করে চলছে তা মূল্যায়ন ও পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিকে সামনে এনেছে। পতিত হাসিনা ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যে করছেন তা ইতোমধ্যে প্রকাশ্য। ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে শেখ হাসিনার নিউজ কাভার করা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তৌফিক হোসেন বাংলাদেশ সরকারের অসন্তোষের কথা ভারতকে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে ভারত সে বিষয়ে কোনো ফিরতি উত্তর দেয়নি। আর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জানিয়েছিলেন বিষয়টি তারা দেখবেন।
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর কতজন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি ভারতে অবস্থান করছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ভারতের ভিসা না পাওয়ায় তৃতীয় দেশের ভিসাপ্রার্থীরা দিল্লির পরিবর্তে ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তান থেকে ভিসা গ্রহণ করতে পারবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশের চারপাশে বন্ধুভাবাপন্ন কোনো দেশ নেই। ভৌগলিক দিক থেকে তিনি দিকে ভারত ও মিয়ানমার রাষ্ট্রের সীমানা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের তিক্ততা রয়েছে। আর ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। যেখান থেকে হাসিনা নানাভাবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছেন বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অভিযোগ করছে।
গণহত্যা, গুম ও খুনের সঙ্গে যারা জড়িত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার কার্যক্রম শুরুর জন্য তদন্ত চলছে। বিচার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে গণত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে ইন্টারপোলের মাধ্যশে দেশে ফেরাতে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে আদালতটির চিফ প্রসিকিউটর একটি চিঠি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ভারত প্রত্যর্পণ আইন মেনে কতটুকু বাংলাদেশকে সহায়তা করবে এখন সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। পররাষ্ট্র নীতি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তা হয়তো দেখতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
২৪ এর গণত্যায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে বিপ্লব হাইজ্যাক হয়ে যাবে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা রাজনীতিতে তাদের পদচারণা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। তারই অংশ হিসেবে ১০ নভেম্বর কর্মসূচি ঘোষণা করে মাঠে নামার চেষ্টা করে। এদিকে ফ্যাসিবাদের সহায়ক শক্তি পলাতক পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশ বাহিনীতে মনোবল ভাঙার চেষ্টা করছেন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর, যারা এখনো পুলিশ বাহিনীতে এখনো লুকিয়ে আছেন- তারা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। একইভাবে মাঠ পর্যায়ে খুনি আওয়ামী কর্মীরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে। এসব কর্মকাণ্ড জুলাই বিপ্লবকে বিপন্ন করে তুলতে পারে বলে হতাশা ব্যক্ত করছেন জুলাই বিপ্লবে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা। তারা মনে করছেন, বিপ্লবের শক্তিগুলোকে বিভেদ নয়, জাতীয় ঐক্যের পথ ধরে রাখতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদে যাতে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি থাকতে না পারেন, বা নতুন করে ঢোকানো না হয়- তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়হীনতা যেন তৈরি না হয়, সেই দাবিও রাখছেন সাধারণ মানুষজন।
গণঅভ্যুত্থানে অবদান রাখা রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দায় সবচেয়ে বেশি। হতাহতদের সংখ্যার দিক বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সমর্থকের পরই বিএনপির অবস্থান। তবে সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের সংখ্যাও অনেক। বিপ্লব যেহেতু বৃহৎ একটি পরিসরকে বোঝায় সেহেতু কাউকে ছোট কিংবা খাটো করার সুযোগ নেই। মৌলিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প থাকে না সাধারণত। ষড়যন্ত্র রুখে দিতে দলীয় কিংবা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে অভ্যুত্থানকারীদের পদক্ষেপ নিতে হবে। জুলাই বিপ্লবে আহত ও শহীদদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করে অভ্যুত্থানের ঐক্যকে সুরক্ষিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনাকাঙিক্ষত ঘটনার নেপথ্যে ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মাদের সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেদিকেও নজর রাখা জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মহল।
আব্দুল্লাহ জিহাদী
মন্তব্য করুন