ছবি: সংগৃহীত।
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন্য সাড়ে ১৫ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মহাস্বৈরাচার শেখ হাসিনা। ভারতও বাংলাদেশের জনগণ নয় বরং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে গেছে কেবল নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য।
ভারত ভালো করেই জানে মেরুদণ্ডহীন হাসিনা সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা সম্ভব। তবু দেশের মানুষ যখন বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে থাকে তখন পায়ের তলার মাটি সরে যায় জাতির কাঁদে সিন্দাবাদের ভুতের মতো চেপে বসা হাসিনার। ভারত নানা চাতুরি করেও তার খাস দাসিকে রক্ষা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত নিজের দেশে হাসিনাকে ঠাঁই দিয়েছে কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই।
বাংলাদেশের সম্প্রতি যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে গেল, ভারতের ওপর তার যেমন রাজনৈতিক প্রভাব আছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রভাবও আছে। ভারতীয় কোনো কোনো গণমাধ্যম মনে করে, এই ঘটনা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবর্তনের ফলে কেবল দুই দেশের অর্থনৈতিক নয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে একের পর এক বাংলাদেশকে জড়িয়ে নানা কল্প-কাহিনী প্রচার করছে। পাশাপাশি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফোরাম ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নেতাদের কাছে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ করছে।
ভারতের এমন অপতৎপরতার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। ভারতের আয়ের অন্যতম উৎস্য বাংলাদেশি পর্যটকরা। হাসিনার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিসা দেয়া বন্ধ রাখায় ভারতের বিভিন্ন হাসপাতাল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও শপিংমলে হাহাকার শুরু হয়েছে। আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে কলকাতার নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী, হাসপাতাল ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা।
ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাষায়, গত এক দশকে বাংলাদেশের যে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার বদৌলতে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম অংশীদার এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহত্তম। পরিবর্তিত বাস্তবতায় ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন ভারতের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা।
সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের অর্থ বাংলাদেশের স্থলপথ এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে দেরি এবং একই সঙ্গে ২০২৩ সালের নভেম্বরে চালু হওয়া আগরতলা-আখাউড়া আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগ আটকে যাওয়া। ভারতের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের পতিত সরকারকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এবং ভারতের অর্থ ও বাণিজ্য সম্ভাবনাকে গুরুতর ঝুঁকির মুখে ফেলা হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি—যেমন জাপান, জার্মানি বা ফ্রান্সে সে পরিমাণ রপ্তানি করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বড় অর্জন ছিল গত এক দশকের বেশি সময় ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। এ সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি তিন গুণেরও বেশি হয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৮৪১ ডলার; ২০২৪ সালে যা ২ হাজার ৬৫০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাত ধরে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের কাতার থেকে বেরিয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এ সময় দারিদ্র্য কমেছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বেড়েছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের আমদানিও বেড়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য অনেকটাই বেড়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্পের সুতা।
ভারত–বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যে হারে বেড়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সেই হারে বাড়েনি। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে এসে ভারতের বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্য আড়াই গুণ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্য বেড়েছে সাড়ে পাঁচ গুণ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভারতের দ্বিপক্ষীয় পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২৪০ কোটি ডলার; ২০২৩ সালে যা ১ হাজার ৩১০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।
এই সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভারতের রপ্তানি যে হারে বেড়েছে, বাংলাদেশে তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। ২০০৯ সালে ভারতের পণ্য বাণিজ্যের ১ দশমিক ২ শতাংশের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ; ২০২৩ সালে যা ২ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩ সালে ভারতের মোট রপ্তানির ১ দশমিক ২ শতাংশ গেছে জাপানে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ, ফ্রান্সে ১ দশমিক ৭ শতাংশ ও জার্মানিতে গেছে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ২০২১ সালে রেকর্ড ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়, যদিও এর পরের দুই বছরে সেটা কমেছে। ২০২২ সালে এই রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে তা আরও কমে এক হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ অবশ্য চাহিদা কমে যাওয়া। ২০২১ সালের পর উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি সীমিত করার সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি কমেছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি কমলে সুতা সবচেয়ে বেশি মার খাবে। ভারতের বৈশ্বিক সুতা রপ্তানির ৩৫ শতাংশ বাংলাদেশে যায়। এতে ভারতের চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে সংবাদে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে সুতার দাম কমতে পারে। তাতে ভারতের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়তে পারে।
সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলমান আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি আরও আক্রান্ত হবে এবং তাতে ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির চাহিদা কমবে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতের ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ, তাদের সেই সক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ভারত থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য আমদানি হয়, যা মোট আমদানির ১৮ শতাংশ। চীন থেকে আসে মোট আমদানির ২৫ শতাংশ। ভারত থেকে যত অর্থমূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ রপ্তানি করে তার ৭ ভাগের মাত্র ১ অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি বিল পরিশোধের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি (৪.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ-ভারত অর্থ ও বাণিজ্য আলোচনায় আরও তিনটি অন্যতম খাত- সেবা, বিনিয়োগ ও রেমিটেন্স। এই তিনটি খাতের ৯৯ শতাংশই ভারতের অনুকূলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ভারতের বিশাল ভোক্তা বাজারে প্রসারের পাশাপাশি কাঁচামাল রপ্তানি, ভারতীয়দের দক্ষ শ্রমবাজার তৈরি এবং ভারতে বাংলাদেশীদের চিকিৎসা ও মেডিক্যাল ট্যুরিজম ইত্যাদি খাত বিগত দুই দশকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
কিন্তু এসব খাতে বাংলাদেশের অবস্থান তৈরি ও উন্নয়নের পথে ভারত নানাভাবে প্রতিবন্ধক দিয়েছে এবং তা করা হয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইনের বেড়াজাল তুলে। ফলে সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সু্িবধা কাজে লাগাতে পারেনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও বিশাল বাজারের দেশ জাপান, জার্মানি বা ফ্রান্সেও সে পরিমাণ রপ্তানি করতে পারেনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সক্ষমতা থাকলেও ভারতে নামমাত্র রপ্তানি করতে পেরেছে। এ কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডেসহ অনেক গণমাধ্যমে গত আগস্টের মাঝামাঝি তাদের প্রতিবেদনে আভাস দিয়েছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও জনগণের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বাংলাদেশে ভারতের অর্থ ও বাণিজ্য অঙ্গনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার বড় একটি ক্ষেত্র রেমিটেন্স।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় অর্থ-বাণিজ্যের মূল পাঁচটি খাত অর্থাৎ আমদানি, রপ্তানি, সেবা, বিনিয়োগ ও রেমিটেন্সে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক পুরোপুরি অসম। একটি বৈষম্যনির্ভর ও শোষণকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে একচেটিয়া ও নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে এবং দ্বিপক্ষীয় নানা ইস্যুতে যেভাবে ভারত সরকার চরম স্বার্থপর আচরণ করেছে তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে বড় ধরনের দূরত্ব ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে।
তারপরও প্রতিবেশী এই দুই দেশকে সহাবস্থানমূলক ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সব পক্ষকেই বুঝতে হবে পারস্পরিক স্বার্থকে শ্রদ্ধা করা এবং মূল্য দেওয়া প্রতিবেশীর স্বচ্ছন্দে জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। তবে সম্পর্কে আস্থা আনতে হলে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ভারতকেই আগে উদ্যোগী হতে হবে।
সরদার একরাম
মন্তব্য করুন