ছবি-সংগৃহীত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ সৈন্যদের দখলে থাকা পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে দলে দলে ভিড়তে থাকে বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা। ধীরে ধীরে তারা শক্তি সঞ্চয় করে। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ-যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে জন্ম নেয় ইহুদিবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। এরপর থেকে নানা কৌশলে ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে বর্বর ইসরাইল।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে চলমান ৯ মাসব্যাপী যুদ্ধেও একের পর এক কৌশল বদল নিরীহ মানুষের ওপর পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।
হামাস যোদ্ধাদের নির্মূলের নামে মূলত সমগ্র ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করেছে ইহুদিবাদী দেশটি। তারা কখনো আবাসিক ভবনে, কখনো স্কুলে, হাসপাতালে, জাতিসংঘ পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে আবার কখনো পলায়ণরত বাসিন্দাদের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করছে।
এমনকি ত্রাণ নিতে আসা নিরন্ন ফিলিস্তিনিদের ওপরও বোমা ফেলেছে মানবতার শত্রু ইসরাইলি বাহিনী। অথচ এসব স্থান বিশ্বের যেকোনো যুদ্ধনীতিতে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসরাইলি বাহিনীও প্রথম দিকে গাজা উপত্যাকার উত্তর দিকের বাসিন্দাদের দক্ষিণে এবং পরে দক্ষিণের বাসিন্দাদের উত্তরে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েও কথা রাখেনি।
অসহায় ফিলিস্তিনিরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেখানেই দানবীয় ইসরাইলি বিমান থেকে টনকে টন বোমা ফেলে তাদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফিলিস্তিনেতর সমগ্র অবকাঠামো।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধে হানাদার ইসরাইলি বাহিনী সর্বশেষ শনিবার (১৩ জুলাই)‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আল-মাওয়াসি এলাকায় প্রাণঘাতী বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের এই হামলায় সেখানে অন্তত ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলায় আরও ২৮৯ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গাজার দক্ষিণের খান ইউনিসের কাছের নিরাপদ অঞ্চলে ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৭১ জন নিহত ও আরও প্রায় ৩০০ জন আহত হয়েছেন। এদিকে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, আল-মাওয়াসিতে হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়েছে।
হামাস বলেছে, খান ইউনিসের কাছে আল-মাওয়াসি এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ওই এলাকাটিকে ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের সেখানে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
ইসরাইলি একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফকে লক্ষ্য করে আল-মাওয়াসির ইসরাইল ঘোষিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ হামলা করা হয়েছে। ওই এলাকায় কেবল হামাসের সদস্যরা ছিলেন। সেখানে কোনও বেসামরিক লোকজন ছিলেন না।
খান ইউনিসে হামাসের কমান্ডার রাফা সালামাকেও এই হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই কর্মকর্তা।
তবে হামাসের নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরাইলি দাবিকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে হামাস। এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠী বলেছে, ফিলিস্তিনি নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করার ইসরাইলি দাবি এটাই প্রথম নয়। অতীতেও তাদের এমন দাবি অসংখ্যবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তারা মূলত কৌশল বদল করে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু শনিবার দিনভর দেশটির কর্মকর্তাদের সাথে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন বলে তার কার্যালয় জানিয়েছে। আল-মাওয়াসির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, হামলার স্থানটি দেখে মনে হচ্ছে সেখানে বড় ধরনের ‘ভূমিকম্প’ আঘাত হেনেছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়া উড়ছে এবং স্ট্রেচারে করে হতাহতদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। লোকজনকে শূন্য হাতে বিশাল গর্তের ধ্বংসস্তূপে মরিয়া হয়ে উদ্ধার তৎপরতার চেষ্টা চালাতে দেখা গেছে।
হামাসের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে ইসরাইলি বাহিনীর এই হামলা উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে দখলদার ইসরাইল যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে আগ্রহী নয়, সেটি পরিষ্কার।
আল-মাওয়াসির কাছে কুয়েতের স্থাপিত একটি ফিল্ড হাসপাতালের ভিডিওতে ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। সেখানে হাসপাতালের মেঝেতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
খান ইউনিসের নাসের মেডিক্যালের চিকিৎসকরা বলেছেন, হাসপাতালে অসংখ্য হতাহত মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার মতো পরিস্থিতি নেই।
হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মাদ দেইফ ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর অন্যতম প্রধান টার্গেট। বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এবং একাধিক হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে ফেরা দেইফের অবস্থান ঘিরে ইসরাইলি বাহিনীর মাঝে ধোঁয়াশা রয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ঢুকে হামলা চালানোর অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে মনে করা হয় তাকে। ওই দিন ইসরাইলে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা ও আরও ২৫১ জনকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে হামাস। পরে সেদিনই গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী। গত ৯ মাস ধরে ইসরাইলি বাহিনীর দানবীয় বিমান ও স্থল হামলায় গাজা উপত্যকায় ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মন্তব্য করুন