• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* জ্বালানি তেলের দাম ১০-১৫ টাকা কমানো সম্ভব : সিপিডি * যুদ্ধ বন্ধ না হলে কোন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবেনা: হামাস * প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন এ এম এম নাসির উদ্দীন * সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ৩৪৩ অ্যাকাউন্টে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ * দায়িত্ব নিয়েছেন নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী * শেখ হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না * আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বাহারুল আলম * সাবেক এমপি শাহজাহান ওমর থানা হেফাজতে * জামিন পেয়েছেন শফিক রেহমান * ইবিতে র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় লিখিত অভিযোগ, তদন্ত কমিটি গঠন

মার্কিন নির্বাচনে কমলার পরাজয় ও নারীর ক্ষমতায়ন

news-details

ছবি: সংগৃহীত।


চার বছর পর গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মূল দুই প্রার্থী ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ছিলেন দেশটির ৪৫তম প্রেসিডেন্ট   আর কমলা হ্যারিস বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। তারা উভয়ই বিভিন্ন ধরনের অঙ্গীকারের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ফলে সমগ্র বিশ্বের চোখ ছিল মার্কিন মুল্লুকে। 

নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের বিপরীতে ভূমিধস বিজয় পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। প্রায় সপ্তাহ ধরে প্রকাশিত ফলে দেখা যায়, ট্রাম্প পেয়েছেন  ৩১২টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। অন্যদিকে কমলা পেয়েছেন ২২৬টি কলেজ ভোট। দেশটির নির্বাচনে মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ২৭০টির প্রয়োজন। আর সেই ম্যাজিক ফিগারে ট্রাম্প পৌঁছে যান সব রাজ্যের ফল প্রকাশের আগেই। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৮ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এক মেয়াদের বিরতিতে দ্বিতীয় বারের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে হোয়াইট হাউসের মসনদে ফিরলেন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনের আগের জনমত জরিপের সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে ৫ নভেম্বর  মার্কিনিরা আরেকবার বেছে নিলেন সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে। এর মধ্য দিয়ে ডেমোক্র্যাট দল থেকে দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশায় গুঁড়েবালি দেখল বিশ্ব। 

কমলা হ্যারিস হেরে গেছেন– এটা শুধু ডেমোক্র্যাটদের একমাত্র হতাশার কারণ নয়।  দলটির অনেক নারীর কাছে এটা একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার, আট বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো একজন ডেমোক্রেটিক নারী প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। 

কমলা হ্যারিস এবং হিলারি ক্লিনটন নাটকীয়ভাবে ভিন্ন পরিস্থিতিতে এবং ভিন্ন কৌশল নিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে উভয়ের ফলাফল একই ছিল। তারা এমন একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে হেরেছেন, যিনি যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত। ট্রাম্প তাঁর বিরোধীদের যৌন এবং বর্ণবাদী ভাষায় অপমান করেছেন। 

প্রশ্ন উঠেছে, কমলা হ্যারিস  কেন পারলেন না যুক্তরাষ্ট্রের মতো নারী স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দেশে সর্বোচ্চ আসনে বসতে। যদি ৫ নভেম্বরের জন রায় কমলা পক্ষে গড়াতো তবে তিনি ইতিহাসের পাতায় দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঠাঁই পেতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ২০১৬ সালে হিলারী ক্লিনটন প্রথম নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্বেও তিনি হেরে গিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। ব্যবসায়ী হিসেবে যিনি আগে থেকেই নারী নিপীড়ক ও চরম মুসলিমবিদ্বেষী গোঁয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।   

নারী স্বাধীনতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে চিরকালই সোচ্চার পশ্বিমা বিশ্ব। বাংলাদেশেও এক শ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিশীলরা নারীর স্বাধীনতার দাবিতে গলা ফাটায়।  ইসলামে নারীর পর্দা প্রথা ও সম্পত্তির অধিকারসহ মর্যাদার বিপরীতে পশ্চিমাদের সবসময় নারীর প্রতি আলগা দরদ দেখা যায়। পশ্চিমারা নারীর স্বাধীনতা নিয়ে যতই চিৎকার করুক না কেন তাদের ইতিহাস বলে ভিন্ন তথ্য। পশ্চিমাদের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও নারীর ক্ষমতায়ন চোখে পড়ে না।

মূলত স্বাধীনতার নামে পশ্চিমারা নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে দেখতে  পছন্দ করে। নারীকে যত ছোট পোশাকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা যায় ততই তাদের বাণিজ্যিক ফায়দা হাসিল হয়। পশ্চিমা নারীরাও তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখ দিয়ে নিজেদের দেখতে অভ্যস্ত। মর্যাদা নয়, নগ্নতাকেই তারা স্বাধীনতা হিসেবে মনে করে। 

পশ্চিমারা অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীকে শীর্ষ কর্মকর্তা নয় বরং কর্মকর্তার প্রাইভেট সেক্রেটারি (পিএস) হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে। খোলামেলা ছোট পোশাকের পিএস থাকলে কাজের পাশাপাশি অফিস প্রধানের বিকৃত যৌনতারও চরিতার্থ হয়। মূলত এ কারণে পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের চাকরিতে প্রবেশের স্বাধীনতা মেলে। পিএসকে দিয়েই যদি যৌন চাহিদা মিটে যায় তাহলে আর স্ত্রী-সংসার কী দরকার।

পশ্চিমা এই বিকৃতি মানসিকার ঢেউ বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বেও লেগেছে। প্রায়ই শোনা যায় অনেক অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তার যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী পিএস। আবার অনেকে চাকরিতে দ্রুত পদোন্নতি কিংবা ভালো থাকার সঙ্গে বসের সঙ্গে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়। ফলে সমাজে যেমন ভাইরাসের মতো বাড়ছে পরকীয়া তেমনি ভাঙছে সংসার, বাড়ছে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ।

নারী স্বাধীনতার ধ্বজাধারী পশ্চিমা বিশ্বেই নারীর প্রতি সবচেয়ে বেশি বৈষম্য, সহিংসতা ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতি দেখা যায়। নারীর নিরাপত্তাও সেখানে সবচেয়ে কম। পুরুষতান্ত্রিক এই দুনিয়ায় নারীদের চলার পথে বাধা প্রতি পদেই। সেই বাধা ঠেলতে ঠেলতেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে নারীদের। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এই পথ চলা যে সুগম নয়, তা ফুটে ওঠে দেশটির প্রায় আড়াইশ বছরের ইতিহাসে এখনও কোনো নারীর প্রেসিডেন্ট না হওয়াটা।

২০২০ সালে ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন ডেমোক্রেটিক পার্টির কমলা হ্যারিস। বয়সের ভারে ন্যুজ বর্তমান  প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী দৌড় থেকে সড়ে দাঁড়ালে ভাগ্য খুলে যায় কমলার। তিনি দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। তার এই এগিয়ে চলাকে নারীর অগ্রযাত্রাও হিসেবে দেখে সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়ান সেলেব্রিটি অনেকে। জেনিফার লোপেজের মতো মার্কিন তারকা গায়িকা-অভিনেত্রী এবারের ভোটে কমলাকে সমর্থন দিয়ে বলেছিলেন, “আমি নারীর শক্তিতে বিশ্বাস করি।”

গত ৩১ অক্টোবর কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন জেনিফার লোপেজ। আরেক তারকা গায়িকা টেইলর সুইফটও সমর্থন জানিয়েছেন কমলা হ্যারিসকে। তিনিও বলছেন, “আমি কমলা হ্যারিসকে ভোট দেব, কারণ তিনি অধিকারের জন্য লড়াই করেন।” কমলাকে ‘যোদ্ধা’ অভিহিত করে তিনি বলেন, একজন যোদ্ধাই পারে চ্যাম্পিয়ন হতে।

কমলার প্রতি সমর্থন দেন সাবেক ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামাও। ডেমোক্রেট প্রার্থীর পক্ষে কথা বলেছেন অভিনেতা জর্জ ক্লুনি। কমলা সমর্থন পান অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো, লিওলার্ডো ডিক্যপ্রিওর মতো জনপ্রিয় তারকারা। 

কিন্তু একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে কতটা প্রস্তুত ছিল মার্কিনিরা ? ইতিহাসের দিকে চোখ রাখলে সেই প্রশ্ন এসেই যায়। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। পপুলার ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে যার কাছে হার মানতে হয়েছিলেন, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পই এবার তার দলেরই আরেক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হলেন।

একাধিক নারী নিপীড়নের অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলা ট্রাম্পকেই শেষ পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন দেশটির অধিকাংশ নারী। তাদের অনেকের দৃষ্টিতে কমলা হ্যারিস ‘অ্যারোগেন্ট’। অর্থাৎএতদিনেও দেশের জন্য তিনি ভালো কিছু করেননি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হরেক রকমের অভিযোগ। দেশটিতে দুই বার অভিশংসিত হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট তিনি। ফৌজদারি মামলায় দোষি সাব্যস্তও হয়েছেন তিনি। এত অভিযোগ নিয়ে কেউ কোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারেন তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন ট্রাম্প ।

২০২৩ সালে এক ডজন নারী যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গভর্নর হিসেবে কাজ করেন, যা দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। তবে এটাই শেষ কথা নয়। অনেক মার্কিন নাগরিক বলেছেন, ‘আমরা নির্বাহী পদে নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি দেখছি। তবে নারীদের প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চাই না। কারণ গভর্নররা সাধারণত জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন না।’ তারা বলেন, ট্রাম্প কমলাকে বিশ্বনেতাদের ‘খেলার পুতুল’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। 

ট্রাম্প জেন্ডার ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছেন। ট্রাম্প প্রায়ই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় বলতেন, কমলা পেশাগতভাবে ওপরে ওঠার জন্য শরীরকে ব্যবহার করেছেন। এমনকি কমলাকে যৌনকর্মী হিসেবেও ইঙ্গিত করেন। 

এবারের নির্বাচনে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের বড় প্রশ্ন ছিল - যুক্তরাষ্ট্র - কী প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? তবে বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানের চালানো জনমত জরিপে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলীয় দুই প্রার্থীর মাঝে ব্যাপক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ছিল। তবে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আখেরে বাজিমাত করেন নারী নিপীড়ক ট্রাম্প।

বিশ্লেষকরা কয়েকটি বিষয়কে ট্রাম্প ও কমলার জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে– মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন, ডেমোক্র্যাটবিমুখ আরব-মার্কিনি ভোটার ও নারী-পুরুষ বৈষম্যের মতো বিষয়। তবু ট্রাম্পের জয়ে কমলার সমর্থক অনেক নারীর মনে দুঃখ ও বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। তারা ভাবছেন, আমেরিকানরা আসলে আবারও একজন নারীকে হোয়াইট হাউসে পাঠানোর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা নারীকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে নেয়, ভোগের পণ্য হিসেবে দেখতে চায়।


সরদার একরাম

মন্তব্য করুন

2 মন্তব্য