ছবি: সংগৃহীত
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরে দুই মাসের ব্যবধানে ফের সহিংসতা শুরু হয়েছে । গত প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যটিতে হিন্দু মেইতেই জনগোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে খ্রিস্টান নাগা-কুকিদের মধ্যে থেমে থেমে সহিংসতা চলছে।
শনিবার থেকে নতুন করে সহিংসতার পর রোববার বিকাল থেকে রাজ্য সরকার ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, বিষ্ণুপুর, থৌবল এবং কাখচিংসহ পাঁচটি জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে।
আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাত জেলায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী ও আসাম রাইফেলসের সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
গত ১১ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ মেইতেই সম্প্রদায়ের ছয়জনের (৩ নারী ও ৩ শিশু) লাশ উদ্ধারের পর শনিবার থেকে এই গণবিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যটিতে।
গত সপ্তাহে জিরিবাম জেলায় মণিপুর পুলিশ ও কুকি বিদ্রোহীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। ওই ঘটনার পর থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন। শুক্র ও শনিবার তাদের লাষ উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৭ নভেম্বর। সেদিন থেকেই পশ্চিম মণিপুরের জিরিবাম, মধ্য ও দক্ষিণ মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল উত্তেজনা দেখা দেয়। কারণ সেদিন রাতে জিরিবাম জেলায় এক স্কুলশিক্ষিকাকে ধর্ষণের পর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তিনি তিন সন্তানের মা ছিলেন।
ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ওই নারী ছিলেন আদিবাসী হামর গোষ্ঠীর অধিবাসী। হামররা নাগা-কুকিদের জ্ঞাতিভাই। তাদেরসহ সেখানকার কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠীকে একত্রে ‘জো’ বলে ডাকা হয়।
এ ঘটনার জেরে গত ৯ নভেম্বর মধ্য মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলায় আরেক নারীকে গুলি করে হত্যা করে সন্দেহভাজন কুকিরা। এই নারী ছিলেন মেইতেই সমাজের সদস্য। তিনিও তিন সন্তানের মা ছিলেন।
এরপর ১১ নভেম্বর দক্ষিণ আসামঘেঁষা জিরিবাম জেলার বোড়োবেকরা এলাকায় মণিপুর পুলিশের একটি থানায় হামলা চালায় সশস্ত্র কুকিরা। এই থানায় অতীতেও বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল তারা।
থানায় হামলার পর সশস্ত্র কুকিরা কাছের জাকুরাদর কারং নামের একটি এলাকায় গিয়েও চামলা চালায়। সেখানকার বাড়িঘরে আগুন লাগাতে শুরু করে। পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধও শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১০ সশস্ত্র কুকি।
তাদের দেহ মিজোরামে নিতে চেয়ে গত সোমবার থেকে শিলচরের হাসপাতালের মর্গ ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল কুকিরা। শনিবার সকালে পুলিশ ১০ জনের দেহ নিয়ে কুকি অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুরের দিকে রওনা হলে তাদের ঘেরাও করে কুকিরা। বিক্ষোভ দমন করতে লাঠি চালায় পুলিশ।
অভিযোগ ওঠে, সেই সময় একদল সশস্ত্র কুকি মেইতেই সম্প্রদায়ের তিন নারী ও তিন শিশুকে অপহরণ করে।
পরে সেই ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার ঘিরে গত শনিবার থেকে শুরু হয় মেইতেইদের বিক্ষোভ। শনিবার মেইতেই বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে এসে যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইম্ফলে তিন মন্ত্রী ও ছয় বিধায়কের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। শনিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের পৈতৃক বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
রবিবারও বিক্ষোভ-সহিংসতা চলে। এদিন বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে দুদিনের কারফিউ জারির আগে সরকার শান্তি নিশ্চিত এবং ‘নারী ও শিশুদের হত্যাকারীদের’ শাস্তি দিতে না পারলে বিক্ষুব্ধ জনতা বিধায়কদের পদত্যাগের দাবি জানায়।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির কয়েকজন বিধায়ক দুই-একদিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে পারেন বলেও খবর রয়েছে।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরে জাতিগত উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং কয়েকমাস পরপরই সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে রাজ্যের হিন্দু মেইতেইদের সঙ্গে খ্রিস্টান নাগা-কুকিদের সহিংসতা হয়।
গত বছরের মে মাসে মণিপুর রাজ্যের বড় জাতিগোষ্ঠী মেইতেইদেরও ‘শিডিউল ট্রাইব’ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তার প্রতিবাদ জানাতে গেলেই মেইতেইদের সঙ্গে নাগা ও কুকি এবং জো জাতির অন্যদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়।
ওই ঘোষণার পর মণিপুর রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ইম্ফল উপত্যকার চারদিকে পাহাড়ি এলাকায় বাস করা নাগা ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
নাগা ও কুকিদের অভিযোগ, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে থেমে থেমে চলা এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।
মণিপুরের কেন্দ্রে অবস্থিত ইম্ফল উপত্যকা রাজ্যটির প্রায় ১০ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত। মূলত মেইতেইরা এই ১০ শতাংশ ভূমিতে বাস করে। তাদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। রাজ্যের বিধানসভায় মেইতেইদের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি।
অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশেপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে বাস করে কুকি ও উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা।
খ্রিস্টধর্মের অনুসারী কুকি ও নাগারা মণিপুরের ৩৫ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। এই পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ।
মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের অনুমতি ছিল না মেইতেইদের। অন্যদিকে কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ ছিল না।
কিন্তু বিজেপি সরকার মেইতেইদের শিডিউল ট্রাইব বা তফসিলি গোত্র ঘোষণা দেওয়ায় তাদেরও এখন পাহাড়ি বনাঞ্চলে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। আর এ নিয়েই শুরু হয় এই জাতিগত সংঘাত।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মন্তব্য করুন