• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* রাজধানীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ২ * লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪ * ইউনূসকে নিয়ে অযথাই শঙ্কায় নয়াদিল্লি * ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত মানবে না ছাত্রদল * জাবিতে শামীমকে পিটিয়ে হত্যায় ছাত্রলীগ নেতা হাবিব গ্রেফতার * তোফাজ্জল হত্যার দায় স্বীকার করে ৬ ঢাবি শিক্ষার্থীর জবানবন্দি * যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জামায়াতকে প্রস্তুত থাকতে হবে : বুলবুল * ফ্যাসিবাদের দোসর অনেক সচিব নাশকতার চেষ্টা করছেন: রিজভী * তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার অনুরোধ সেনাবাহিনীর * চেন্নাই টেষ্টে দ্বিতীয় দিনে ১৭ উইকেটের পতন, ব্যাকফুটে বাংলাদেশ

যেমন বাংলাদেশ চাই

news-details

সংগৃহীত ছবি


অনাদিকাল থেকেই বাংলার ইতিহাস সংগ্রামের। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে তারুণ্যের অবদান অনস্বীকার্য। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তরুণদের সাহসী ভূমিকার ফলে আমরা পাই আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় সম্মান। ৬৯- এর গণঅভু্যত্থান ও হয়েছিল তরুণদের হাত ধরে। এরই ধারাবাহিকতায়, '৭১-এর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দুর্নিবার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পাই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

সংগ্রামী চেতনায় লালায়িত তারুণ্যের হাত ধরেই বাংলাদেশ এসেছে। ফলে '৯০-এর আন্দোলন, ২০০৭-এর আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের একনিষ্ঠ ভূমিকা অস্বীকার্য। এ দেশের মানুষ যেমন শান্তিপ্রিয়, তেমনি বৈষম্যে প্রতিরোধ করার অপ্রতিরোধ্য সাহস নিয়ে সংগ্রাম করতে সদা প্রস্তুত। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘিরে তরুণদের অনস্বীকার্য ভূমিকার দরুন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের রূপ নিয়ে স্বৈরাচার পতন করতে সচেষ্ট হওয়ার নজির বিরল। ইতিহাসের শিক্ষাই হলো কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না; যার পুনরাবৃত্তি ঘটল নব্বই দশক পরবর্তী একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। তারুণ্যের চাহিদা সঠিকভাবে অনুধাবন না করায় দম্ভের পাহাড় ভেঙে চুরমার! সম্প্রতি কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার পতনের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আন্দোলনে যোগ দেয় সাধারণ জনগণ। ফলে সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় ফ্যাসিবাদ সরকারপ্রধান। বিগত সময়গুলোয় অনেক আন্দোলন গড়ে তুললেও সরকার পতন করতে পারেনি কোনো রাজনৈতিক দল; কিন্তু এবার তরুণ ও ছাত্রসমাজের আন্দোলনের কারণে তা সম্ভব হয়।

তবে এখন প্রশ্ন, কেমন হবে আগামীর প্রত্যাশিত বাংলাদেশ? কোটা আন্দোলন ঘিরে সারাদেশব্যাপী যে আন্দোলনের শুরু হয় তার অগ্রপথিক হিসেবে তরুণদের পথ দেখান ছয় তরুণ সমন্বয়ক এবং তরূণরাই পারবে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে। ছয় সমন্বয়কের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন- 'আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে মিডিয়ার ভাইরা সত্য প্রচার করতে পারবে, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই যার মাধ্যমে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারব, এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চাই যাতে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পায়, এমন বিচার ব্যবস্থা চাই যেখানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার পাবে, এমন একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাই যা আপামর জনসাধারণের আস্থার জায়গা হবে।' তাই তরুণদের এই চিন্তাধারা থেকেই আমাদের নতুন সোনার বাংলা গড়তে হবে।

দেশের ছাত্রসমাজ সাধারণ জনগণের যে আস্থা অর্জন করেছে তাতে সাধারণ জনগণও চাইছে আগামীর বাংলাদেশ তরুণদের হাতেই নিরাপদ। একজন প্রকৃত তরুণ ছাত্র পড়াশোনার মাধ্যমে এমন জায়গায় আসবে যেখানে তার দেশের প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা থাকবে এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত দ্রম্নত ও সঠিকভাবে নেওয়ার সক্ষমতা থাকবে। একটি দেশ তখনই স্বাধীন হয়, যখন দেশের সাধারণ মানুষ তাদের বাকস্বাধীনতা পায়, ন্যায়-অন্যায় মাথা উঁচু করে বলতে পারে, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য তেলবাজি করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় না। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের মূলভিত্তি হচ্ছে- দেশের আইন, বিচার ও শাসনবিভাগ। আইনবিভাগ আইন প্রণয়ন করবে, বিচারবিভাগ সেই অনুযায়ী সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার করবে এবং শাসনবিভাগ ওই আইনের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। সোনার বাংলা গড়তে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকেও সুনজর দিতে হবে।

সরকারি হাসপাতালগুলোয় আরও উন্নত ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। একই ডাক্তারের কাছে হাসপাতালে একরকম চিকিৎসা আবার ক্লিনিকে অন্যরকম চিকিৎসা, এ রকম যেন না হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া দরকার যাতে দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নত ও গবেষণাধর্মী শিক্ষা, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সুব্যবস্থা থাকে। দেশের বাহিরে যারা উচ্চ শিক্ষার জন্য যায় তাদের সঠিক মূল্যায়ন করে দেশের সম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে একটি দেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা বেকারত্ব। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনঃগঠনের জন্য অবশ্যই বেকারত্ব দূর করতে হবে। মানবসম্পদকে দক্ষ জণশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে আগামীর সোনার বাংলাদেশ। জয় হোক তারুণ্যের, গড়ে উঠুক সোনার বাংলা।

ছাত্রদের খেপিয়ে, ছাত্রদের রক্ত ঝরিয়ে কেউ কখনো টিকে থাকতে পারেনি। ইতিহাসের স্রোতধারায় যারা এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের সবারই করুণ পরিণতি হয়েছে। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই এর প্রমাণ দেখতে পাব। যারা সামান্য লোভের বশবর্তী হয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, তাদের পরিণতিও শেষ পর্যন্ত ভালো হয় না। ইতিহাস তাই বলে। মীরজাফররা সাময়িক ভালো থাকলেও প্রকৃতি কখনো তাদের ক্ষমা করে না, তারা ‘রিভেঞ্জ অব ন্যাচার’ থেকে কোনোভাবেই বাঁচতে পারে না। কর্মের করুণ ফল তাদের ভোগ করতেই হয়।

সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অনেক তরুণ শহিদ হয়েছেন, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। যাদের দায়িত্বহীনতা ও উসকানিতে এতগুলো প্রাণ নির্মমভাবে ঝরে গেল, সেটারও সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর আর নব্বইয়ের মতো চব্বিশেও তারুণ্যের জয় হয়েছে। আর এ জয় আগামীর বাংলাদেশের জন্য বড় দৃষ্টান্ত। তরুণ সমাজ চাইলেই যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, তারুণ্যের শক্তির কাছে যে সব শক্তি পরাহত হয়-এ আন্দোলন তার বড় দৃষ্টান্ত। আমাদের রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, আসাদ, মতিউর, নূর হোসেন, মাস্টারদা সূর্য সেন, বীরকন্যা প্রীতিলতাদের দেশপ্রেম ও আত্মদান এ দেশের ছাত্রসমাজের রক্তে মিশে আছে। এদের প্রতিহত করবে কোন্ কালশক্তি? কালশক্তিকে পরাজিত করে এ দেশের তরুণ সমাজ বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে, অবশেষে এসেছে সে বিজয়। তরুণ প্রজন্ম যে একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ, সে কথা আমাদের রাষ্ট্রনায়করা ভুলে গিয়েছিলেন। আগামীর রাষ্ট্রনায়কদের তরুণ সমাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, রাষ্ট্র বিনির্মাণে তাদের চিন্তা ও মতকে গুরুত্ব দিতে হবে। তারুণ্যের এ আন্দোলন আগামীর রাষ্ট্রনায়কদের জন্য বড় শিক্ষা।

আগামীর বাংলাদেশকে বিনির্মাণে দেশপ্রেমিক, সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী ও চৌকশ মানুষদের গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে অস্তিত্বহীন রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি : জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমূলে উৎপাটন করতে হবে। কেড়ে নেওয়া মানুষের ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মুক্তমত ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা। একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণকে ‘খেলার পুতুল’ বানিয়ে রাখার হাতিয়ার হলো ভোটাধিকার হরণ করে নেওয়া। জনগণের সে ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আরও খেয়াল রাখতে হবে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কেউ যাতে ‘দুরভিসন্ধি’ করতে না পারে। সব সংকট পেরিয়ে রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশ ভালো থাকুক, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলুক, এটাই প্রত্যাশা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীদের গণ-অভ্যুত্থান যেন এক রূপকথা আর রূপান্তরের বাংলাদেশ। আন্দোলনে অংশ নেয়া থেকে শুরু করে আন্দোলন-পরবর্তী ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, দেয়ালে দেয়ালে রঙিন গ্রাফিতিসহ নিজ উদ্যোগে অনেক দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তরুণ-তরুণীরা। এসব কাজে অংশ নেয়া কয়েকজন তরুণ-তরুণী নতুন বাংলাদেশ নিয়ে বলেছেন তাদের স্বপ্নের কথা।

মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তন আগে দরকার দেশের স্বৈরাচারী সরকার দমনের জন্য আমরা যেমন যে যার জায়গা থেকে নিজেদের সাধ্যমতো কাজ করে গিয়েছি, ঠিক তেমনি সুন্দর একটি দেশের দৃষ্টান্ত তৈরি করার জন্য ছোট ছোট জায়গায়ও কাজ করে যেতে হবে। এ দেশ পরিবর্তন করতে হলে মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তনটা আগে দরকার। এখন যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মিলে দল বেঁধে রাস্তা পরিষ্কার করছি, ট্রাফিক আইন মানতে জোর দিচ্ছি, জিনিসপত্রের দামে খেয়াল রাখা, দুর্নীতি ধরার জন্য আওয়াজ তোলা এসব যাতে শুধু এ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য না হয়। সামনেও যাতে এগুলো আমরা আরো বেশি করে মানি আর এ দেশের মানুষকেও মানতে বাধ্য করি। তাহলে যেমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই তার কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।

কোনো হিংস্রতা নেই, দুর্নীতি নেই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা নেই এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমরা রক্ত দিয়ে এ দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছি। এখনো আমরা সবাই শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করছি, যেন জাতি বুঝতে পারে যে ছাত্ররা দেশকে পাল্টাতে পারবে। সবাই নিজের মতো অবদান রাখার চেষ্টা করছে—কেউ গার্ড ডিউটি, কেউ ট্রাফিক, কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কেউ মন্দির রক্ষার মতো কাজ করছে। এসব দেখে আমি বিশ্বাস করি একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। আমরা ছাত্ররা প্রস্তুত, এ দেশের জন্য যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করার এবং দেশটাকে আবার সুন্দর করে তোলার জন্য। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড— এটি প্রমাণ করার সময় এসে গেছে। আমরা দেখেছি গণতন্ত্রের মোড়কে কীভাবে স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকে। দেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। একেকজন রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন, বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। তাদের হাতেই যেন গোটা দেশটা জিম্মি। এ ঘটনার আর কোনো পুনরাবৃত্তি চাই না।

পশ্চিম পাকিস্তানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যে দেশটির জন্ম, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সে বৈষম্য দূর হয়নি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলদাসত্বমুক্ত একটি দেশ চাই। যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয় বরং যোগ্যতা থাকলে যেন বিরোধী মত, আদর্শের লোকও তার প্রাপ্য বুঝে পায়। এসব সংস্কার করতে পারলে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বেশি দূরে নয়। কেমন বাংলাদেশ চাই প্রশ্নের উত্তরটা দিতে চাই আমি কবির সুমনের ‘আমি চাই মানুষের হাতে রাজনীতি হবে ভীষণ জব্দ’ গানের লাইনটির মাধ্যমে। আমরা অরাজকতার রাজনীতি দেখেছি এতদিন, যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। চাই না আমার দেশে রাজনীতির হাতে জনগণ পুনরায় জব্দ হোক। সত্যিকারের গণতন্ত্র থাকবে এমন একটি বাংলাদেশ চাই। আমরা তরুণরাজীবনের প্রথম ভোটটি দিয়ে আমাদের নেতা নির্বাচন করতে চাই। এ দেশে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষের পরিচয় হবে একবাংলাদেশী। ঠিক এ রকম মানসিকতার বাংলাদেশ চাই, যেখানে একজন সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রতিনিধিরা জবাবদিহিতার আওতায় আসতে বাধ্য হবে। 

স্বৈরাচার থেকে দেশ স্বাধীন করেছি, এবার স্বাধীন হওয়ার সময়। আর রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ অনেক লম্বা। কেউ কেউ বলছেন, এ সংস্কার করবে কারা? আপনি করবেন, আমরা, আপনারা, সবাই মিলে করব। পথপ্রদর্শক হিসেবে থাকবে নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন অভিজ্ঞ সিনিয়র সিটিজেন। বিশ্বসেরা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে যারা বিদেশেই রয়েছেন তাদের দেশে এনে দেশ সংস্কারের কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশের সব স্তরের দুর্নীতি দূর করতে পারলেই কেবল দেশ প্রকৃত অর্থে উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে। শুধু প্রধান দায়িত্বে তরুণরা থাকলে হবে না, দেশ সংস্কারের জন্য সব পরিকল্পনা এক্সিকিউট করার জন্য শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় তরুণ প্রজন্মকে সুযোগ দিতে হবে। 

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও একটি ইম্পার্শিয়াল জুডিশিয়ারি বাংলাদেশ পেল না, এটি খুব দুঃখের। যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাঁর সরকার মঞ্চে উঠেছিল, একটি ‘হুইল অব সিস্টেম’ দাঁড় করানো অসম্ভব ছিল না।

একটি টেকসই রাষ্ট্রকাঠামো, যেখানে নির্বাহী, সংসদ ও বিচার—এই তিনটি বিভাগ আপন শক্তিতে স্বাধীনভাবে চলবে। এই মহৎ স্বপ্নের বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের হাতের মুঠোয় ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই পথে হাঁটেনি। গোটা জাতির মধ্যে একটি ডুয়ালিজম সৃষ্টি করা হলো।

মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ ও ঘৃণা ইত্যাদির চাষাবাদ করা হলো। গোটা দেশটিকে দুই ভাগ করে দেওয়া হলো—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি। অর্থাৎ যিনি আওয়ামী লীগ করবেন, তিনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি; আর আওয়ামী লীগ না করলে তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধী, স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা বা সেক্টর কমান্ডারও হন। সুতরাং তাঁকে মারা, পেটানো, নানা রকম অত্যাচার ও হয়রানি করা সব কিছু বৈধ—এভাবেই সরকার দেশটি চালিয়ে আসছিল। আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে পৃথিবীর সব ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য বা তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে কিছু বয়ান তৈরি করতেন, যা ছিল তাঁর ক্ষমতার মূল ভিত্তি। আসলে ফ্যাসিবাদ সমাজকে মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য হিটলার কিংবা মুসোলিনির মতো বিশাল ‘মহানায়ক’ বানায়, বিস্তর মিথ্যা কেচ্ছা, বয়ান ও ইতিহাস বিকৃতি ঘটায়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট বিরাট ছবি ও ম্যুরাল পথে-ঘাটে, এয়ারপোর্টে, অফিস-আদালতে ভরিয়ে ফেলা দেখেও ফ্যাসিবাদের কায়কারবার আপনি বুঝতে পারেন। শেখ মুজিবুরের অবদান স্বীকার করতে হবে, কিন্তু খেয়াল করুন তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নেতা নন।

আরো একটু ভাবুন, ফ্যাসিবাদ কিভাবে কত অনায়াসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা তর্কবিতর্ক থেকে মুছে ফেলতে পেরেছে। অথচ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন ভাসানী। ভাসানী না থাকলে শেখ মুজিবুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেতেন না। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে তিনি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিপুল মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিলেন। যাদের বেশির ভাগই ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ভাসানী ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় নেতা হতে পারতেন না। হাসিনা সরকারের এমপি ও মন্ত্রীদের কথা শুনলে মনে হতো প্রতিভা, মেধা ও কম্পিটেন্স বলি দিয়ে ‘স্তুতিবাদ’ হয়ে উঠেছে মন্ত্রী হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। একঝাঁক মৃত কাঠের গলায় ঝুলিয়েছে মন্ত্রিত্বের মালা। তাদের কগনিটিভ ডিক্লাইন খুব চোখে পড়ে। যার যা কাজ নয়, সে ওই কাজ নিয়ে দায়িত্ব পালনের অভিনয় করেছে।

স্মরণকালের সবচেয়ে রাষ্ট্রবিনাশী অপচয় ও দুর্নীতির অভিযোগ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে, টাকার মান কমেছে  লুটপাটজীবীর কারণে। গরিব প্রবাসীরা যে ডলার পাঠান, সেই ডলার কর্মকর্তারা বিদেশে দুহাত ভরে খরচ করেছেন। কেউ বাড়ি কিনেছেন, কেউ প্রমোদে গেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লটবহর নিয়ে তিনি  জাতিসংঘে যান। আর্বিট্রারি অ্যারেস্ট, যখন-তখন তুলে নিয়ে যাওয়া, পীড়নমূলক আইন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, টর্চার আন্ডার কাস্টোডি, আয়নাঘর, তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য, নকল দরদ, রঙিন দম্ভোক্তি—এসব মানুষ ভালো চোখে নেয়নি। ভয়ে হয়তো কেউ কিছু বলেনি। পুরো শাসনামলেই মানুষ কিন্তু মনের ভেতর পুষে রেখেছে রাগ ও ঘৃণা। এখন যেকোনো উপলক্ষে এই রাগ উগরে দিচ্ছে। সরকার দুর্নীতি ও মূল্যস্ফীতি রোধে কোনো কার্যকর মেকানিজম গড়তে পারেনি। সরকারপ্রধান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন শোচনীয় ব্যর্থতার। হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ ফুড-রেশনিং করছে। দ্রব্যমূল্যের প্রচণ্ড আঘাতে তারা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। নিকট অতীতে বাংলাদেশে এমনটি ঘটেনি। দ্রব্যমূল্য খুব সিরিয়াস বিষয়। দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এটি গণক্ষোভের জন্ম দিয়ে থাকে।

সাংবাদিকতার রূপ আপনি জানেন না এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। তার পরও বছরের পর বছর সংবাদ সম্মেলনের নামে এ ধরনের কৃত্রিম স্তোত্রের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক দুহাত ভরে সুবিধা লুটেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ও সাংবাদিকতা—দুটিরই বিশ্বাসযোগ্যতা লম্বাকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। দলটি টিকবে কি না, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংগঠনটি স্বাধীনকাঠামো নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এমন চিন্তা কখনো করেছে বলে মনে হয় না। এককালে আওয়ামী লীগ জনগণের দল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানানো হয়েছে দলীয় কার্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের এলাকা। শিক্ষিতদের চারণভূমি। এলাকাটির সব লোক একযোগে নষ্ট হবে? বেছে বেছে সবচেয়ে বাঁকা, সবচেয়ে অকেজো লোকটিকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগকে বানানো হলো দলীয় লাঠিয়াল। 

একটি সফল আন্দোলনেরপর সবার চাওয়া থাকে, দেশ যেন সুন্দরভাবে এগিয়ে যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এর সমন্বয়কেরা। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আমরা সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট করতে চাই। নীতির ঊর্ধ্বে কেউ উঠতে পারে না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক খাতকে দ্রুততম সময়ে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে। বিচার বিভাগেরও সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। মোটাদাগে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। গণমুখী ও মৌলিক নাগরিক সেবাগুলো নিশ্চিত হলে একটি সমৃদ্ধ দেশ হবে আমাদের। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে, দ্রুততম সময়ে এ বিষয়গুলোর দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে চাই।

হাসনাত আব্দুল্লাহ, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রধান লক্ষ্য হোক রাষ্ট্রের সংস্কার এমন দেশ চাই যেখানে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ—সবাই নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবে। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মানুষকে সম্মান করে সর্বোচ্চ সেবা দেবেন। একই সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ দেখতে চাই। রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টর ভেঙে পড়েছে। এই সেক্টরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অসৎ, চাটুকার এবং অযোগ্যদের বহিষ্কার করে সেখানে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা খাত ঢেলে সাজাতে হবে। এই ৩টি খাতে উন্নতি করতে পারলে দেশ পাল্টে যাবে। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হবে রাষ্ট্রের সংস্কার। এর মাধ্যমে এমন একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যেখানে সরকার বদল হলেও দেশে তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসহ রাষ্ট্র সংস্কার করলে সমতাভিত্তিক দেশ গড়া সম্ভব হবে। 

উমামা ফাতেমা, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন স্বাবলম্বী দেশ দেখতে চাই নতুন বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী হিসেবে দেখতে চাই। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতির অবসান দেখতে চাই। সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের স্বীকৃতি ও অধিকার রক্ষা করা হবে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গা থাকবে। দেশীয় শিল্প পুনরুদ্ধার করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কার্যকরী পরিবর্তন আনতে হবে। গবেষণার সুযোগ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মাইশা মালিহা, সহসমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল সিস্টেমের পরিবর্তনযে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ—এ সিস্টেম বদল করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে হবে। আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবা সুনিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে, দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে উন্নয়ন ও মাঠের পরিস্থিতি সমুন্নত থাকবে। আমরা আমদানিনির্ভর না হয়ে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ দেখতে চাই। পাশাপাশি সেক্টরভিত্তিক কাজের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারি ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির ফলে অছাত্ররা ছাত্রসংগঠনে এলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনো অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে না। আমরা এখানেও পরিবর্তন চাই। আবদুল কাদের, সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংস্কারে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা থাকতে হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই। দেশের প্রতিটি ইনস্টিটিউট হবে স্বাধীন ও রাজনীতিমুক্ত। বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন। সেখানে সবার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। আমরা শিক্ষাব্যবস্থার এমন পরিবর্তন চাই, যার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উদাহরণ হয়ে উঠবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্কার চাই। তারা যেন রাজনৈতিক নেতাদের আজ্ঞাবহ হয়ে না থাকে। দেশের এসব সংস্কারমূলক কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে।


অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ

মন্তব্য করুন