ফাইল ছবি
আফগানিস্তানকে পৃথিবীর অপরাজেয় জাতির বাসস্থান বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, একে ‘পরাশক্তিদের গোরস্তান’ নামেও অভিহিত করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ।
আফগানিস্তান ইরানের পার্বত্য অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত। পর্বতমালার রেঞ্জ এবং মালভূমি অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ দখল করে রেখেছে। মাত্র ২০% সমভূমির এদেশটিতে শুষ্ক আবহাওয়া বিদ্যমান। এ কারণে এর বেশিরভাগ অংশই মরুভূমি হওয়ায় এদেশের মানুষের মেজাজ বেজায় রুক্ষ। প্রজাতন্ত্রের প্রতিবেশীরা হলেন ইরান, পাকিস্তান, চীন, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান, পাশাপাশি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য। চারদিকে এসকল দেশ দ্বারা বেষ্টিত এবং এর কোন সমুদ্র সীমা নেই।
আফগানিস্তান যে অঞ্চলে অবস্থিত তা বরাবরই ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে সারাবিশ্ব। দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের মধ্যে অবস্থিত দেশটি প্রায়শই তার গুরুত্ব পরাশক্তিগণ অনুভব করে। ফলে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনের স্বীকার হয়েছে বার বার।
দেশটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, প্রায় ২০ টি জাতীয়তা রয়েছে যা তুর্কি, মঙ্গোলিয়ান, ইরানি, দারিশ এবং দারভিডিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের প্রভাবশালী জাতিগত গোষ্ঠীটি পশতুন যারা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% বলে পরিসংখ্যানে প্রকাশ। তারা তাদের গোত্রপতি "খান" এর নেতৃত্বে পরিচালিত উপজাতি এবং কয়েকশো গোত্রকে নেতৃত্ব দেয়। মূলত এরা গোত্রীয় নেতা বা মালিকদের দ্বারা শাসিত হয়। দেশটির আরেকটি বৃহৎ নৃগোষ্ঠী হল তাজিক, যা জনসংখ্যার প্রায় ৩০% বলে তথ্য দিচ্ছে আদমশুমারি। তাদের পরে সর্বাধিক সংখ্যক গ্রুপ হল হাজারা ও উজবেক। এছাড়াও, নূরস্তানিস, বালুচিস, তাজিক, পশাই, চরাইম্যাকস, ব্রাগুই এবং অন্যান্য জাতির লোকজনও এদেশে বাস করে থাকে। এর সিংহভাগ বাসিন্দা সুন্নি ইসলামকে মনে চলে। এছাড়াও শিয়া মুসলিম, শিখ, জুরোস্ট্রিয়ান, হিন্দু এবং বাহাই উপজাতির বসবাস এদেশে বিদ্যমান।
তালেবান কারা:
এটি আফগানিস্তানের দেওবন্দপন্থি ইসলামি ছাত্র আন্দোলন এবং সামরিক সংগঠন। ২০১৬ সাল থেকে মৌলভি হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তালেবান নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অঞ্চল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তারা সেখানে ইসলামি আইন (শরিয়ত) প্রণয়ন করেছিলো যার ভিত্তিতে তারা দেশটি পরিচালনা করতো। ১৯৯৪ সালে আফগান গৃহযুদ্ধের অন্যতম প্রধান দল হিসেবে তালেবানের আবির্ভাব ঘটে আফগানিস্তানের ত্রাতা হিসেবে।
এই দলটি মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের পশতুন এলাকার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় যারা ঐতিহ্যবাহী ইসলামি বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেছিলো এবং সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধের সময় দেশ রক্ষায় যুদ্ধ করেছিলো। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবান আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানকে তারা ইসলামি আমিরাত ঘোষাণা করে এবং রাজধানী কান্দাহারে স্থানান্তর করে।
১১ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আক্রমণের পর ক্ষমতাচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল তালেবান নিয়ন্ত্রণ করেছে। আফগানস্তানে তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলো পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। পরে এই দলটি আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কারজাই প্রশাসন এবং ন্যাটো নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনীর (আইএসএএফ) বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি বিদ্রোহ আন্দোলন হিসেবে জনগণের মণিকোঠায় স্থান করে নেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলে থাকে, তালেবানের প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায় থাকাকালীন পাকিস্তান ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স ও সামরিক বাহিনী তাদের সহায়তা প্রদান করেছে এবং বিদ্রোহের সময় তালেবানদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলের পতনের মধ্য দিয়ে তালেবান আফগানিস্তানের শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।
শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলাই তালেবানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ:
ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর গত ১৫ই আগস্ট কাবুলে তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার বলেছিলেন "আমরা এমন একটি সরকার গঠন করার চেষ্টা করছি যাতে আফগানিস্তানের সকল জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে। এছাড়াও তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ্ মুজাহিদ তার বক্তব্যে বলেছিলেন, "আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই,"। কথা নয় কাজের মাধ্যমে তালেবানের মূল্যায়ন করতে হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, "ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান গোটা বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায়। আমেরিকাসহ বিশ্বের সব দেশের সাথে আমরা শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।" রাশিয়ার নেজাভিসিমিয়া গাজেটা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে,"সারা বিশ্ব গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য রাখছে তালেবানের উপর,তালেবান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব শিগগীরই স্বীকৃতি পাবে, এমন সম্ভাবনা কম,"। আফগানিস্তানে কখনোই সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে ওঠেনি এর বহজাতিক গোষ্ঠী শাসন কাঠামোর কারণে। রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে স্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার দেখা আফগানিস্থান কখনোই দেখেনি। সেখানে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থান্বেষী অপতৎপরতা তো ছিলই।
সার্বভৌমত্ব বলতে সেই চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে বুঝায়, যাকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। রাষ্ট্রের ভিতরে প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যে ক্ষমতা মেনে চলে এবং না মানলে দন্ডনীয় হয়। যে শক্তি বিদেশের কোন নিয়ন্ত্রণ মানে না, সেটাই হল সার্বভৌম শক্তি। রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ক্ষমতা নির্দিষ্ট ভূখন্ডের বাইরে প্রযোজ্য হয় না। যেটার অস্তিত্ব আফগানিস্তানে ছিল না। সার্বভৌম ক্ষমতা হল সর্বব্যাপক, স্থায়ী, অবিভাজ্য, হস্তান্তরের অযোগ্য, মৌলিক, চরম ও সীমাহীন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবি বলেছেন, রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই হচ্ছে সার্বভৌমিকতা’। রাষ্ট্রের ইচ্ছা বলতে এখানে জনগণের ইচ্ছাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা রাষ্ট্র কোন প্রাণী নয় বা তার কোন ইচ্ছাশক্তি নেই। আর এ কারণেই এযুগে বলা হয়ে থাকে যে, ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ এবং ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’। এজন্য আফগানিস্তানে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা জরুরী।
খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী হতে এযাবত বিতর্ক চলছে, রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য, না ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য। অধ্যাপক ল্যাস্কি, মেটল্যান্ড, গিয়ার্কে, বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তো পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার নয়। এটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত অন্যান্য সংঘ ও সমিতির মধ্যে অবস্থিত। এ মতের অনুসারীদের অনেকে এমনও মত প্রকাশ করেছেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার তিরোধান হওয়া আবশ্যক। কারণ সার্বভৌমত্বের মৌলিক দর্শন হল, সর্বোচ্চ সত্তার সীমাহীন ক্ষমতার অধীনে মাটি ও মানবতা নিরাপদ থাকা। যা ক্ষমতালোভী মানুষের কাছে নিরাপদ নয়। এ জন্য খোদার সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ তৈরী করা করা দরকার। শাসক ও জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কিভাবে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় তার রুপরেখা তৈরী করা জরুরী। রাষ্ট্রের শক্তিকে যারা প্রতিরোধ করতে আসবে তাদের অবস্থান গুড়িয়ে দিতে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা এবং গোটা দেশকে নিয়ন্ত্রনে আনা। মোদ্দাকথা হচ্ছে পুরো দেশের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা।দেশ পরিচালনার জন্য অতিদ্রুত সংবিধান প্রণয়ন করা তালেবানের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা জনগণকে শাসন কাঠামো না দিতে পারার কারণে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে পারেনি। যেখানে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া সফল হয়েছে এদিকেও তালেবানের নজর দেওয়া জরুরী।
আফগানিস্তানে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করা সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রকাঠামোয় দেশদ্রোহীরা যাতে সুযোগ না পায় সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদালত গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশপ্রেমিক নেতা তৈরীর জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ হওয়া দরকার। যাতে করে অতিদ্রুত বিশ্বরাজনীতিতে প্রবেশ সহজ হয় এবং স্বীকৃতি আদায় করা যায়। কেননা এমূহুর্তে বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি একান্ত জরুরী। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শাসিত ও রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান। সেক্ষেত্রে তালেবান কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা আজও নির্ধারণ করতে পারেনি। ভুলে গেলে চলবে, না জনগণের মতামত ছাড়া কোন সরকার ব্যবস্থা আধুনিক সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সেক্ষেত্রে ইরান মডেল অথবা তুর্কি মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এর বাইরে কোনো উন্নত মডেল থাকলে তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা দরকার। কারণ শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ার ইসলামী জাতিয়তার ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে গিয়েছিল।
লেখক : আব্দুল খালেক
মানবাধিকার কর্মী ও কলামিস্ট
আব্দুল খালেক
মন্তব্য করুন