ড. আতিউর রহমান, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
দেশের ৩ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। এনএনবিডিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। এসময় দেশের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ, দারিদ্র্য বিমোচনে চ্যালেঞ্জ, ডলার সংকট, রেমিট্যান্স, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন অভিজ্ঞ এই অর্থনীতিবিদ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে দেশের বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা নীতি কতটুকু সহায়ক বলে মনে করেন আপনি? ঘাটতি থাকলে সেগুলো থেকে উত্তরণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. আতিউর রহমান: দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের সাফল্য অসামান্য। গত দেড় দশকে দারিদ্র্য নিরসনের হার ৪০ শতাংশেরও বেশি থেকে কমে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আর দুই শতাংশের মতো কমলেই আমরা শূন্য অতি দারিদ্র্য হারের দেশে পরিণত হবো।
এতো কিছুর পরেও ৩ কোটির বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্য রেখার নিচে বাস করেন। জলবায়ু শরণার্থীসহ নগর দারিদ্র্য এখনও ভয়াবহ। আর নদীভাঙ্গন, বন্যা, ঘূর্নিঝড়, লবণাক্ততার কারণে চরাঞ্চলসহ অনেক জেলায় দারিদ্র্যের হার অস্বাভাবিক পর্যায়ে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নীতি নেবার ফলে কৃষি ঋণ, এসএমই ঋণ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে গাটছড়া বেধে ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদে উদ্যোক্তাকে সমর্থনের সুযোগ করে দেয়ায় কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি দারিদ্র্যও কমেছে। আর মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংসহ ডিজিটাল অর্থায়নের মাধ্যমে পুরো দেশের অর্থনীতি অনেকটাই গতিময় হয়েছে এবং এর প্রভাবে দারিদ্র্য নিরসনেও গতি পেয়েছে। আর কৃষির প্রবৃদ্ধির হারও ভালো থাকায় গ্রামীণ দারিদ্র্য অনেকটাই কমেছে।
এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক এলাকায় দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হতে দেখা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে যেসব আর্থিক কৌশলে দারিদ্র্য কমেছে, সেগুলো আরও কার্যকর করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতেও নতুনত্ব আনার সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু-বান্ধব বাজেট ও ঋণ নীতি এবং ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধ কর্মসূচি দারিদ্র্য নিরসনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে এফডিআই আসছে অনেক। এক্ষেত্রে আইএমএফ, এডিবিসহ বৈশ্বিক ঋণদাতারা বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোসহ সামগ্রিক উন্নয়নে ইতিবাচক দিক কতটুকু? আর নেতিবাচক দিক আছে কি না? অনেকের সমালোচনাও আছে যে আইএমএফের শর্তের বেড়াজালে পড়ে যেতে পারে দেশ- যেখানে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কার কারণ কি থাকতে পারে?
ড. আতিউর রহমান: এখন বাংলাদেশে এফডিআই(প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) আগের মতো আসছে না। তবে আন্তর্জাতিক আর্থিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে এখন যথেষ্ট বিদেশি সহায়তা আাসছে। দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রচুর ঋণ পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। রাস্তাঘাট, সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মাসেতুসহ অনেক মেগাপ্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। এসবের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে বেশি করে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো করলে, সেই ঋণ ও তার সুদ শোধ করতে রাজস্ব বাজেটের বিরাট অংশ চলে যাবে। এটা হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারের বাজেটের সক্ষমতা কমে যায়। আর আয় বুঝে ব্যয় না করলে একসময় বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায়। সেসময় আরো বেশি ঋণ করতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংকিং খাত থেকে। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আশঙ্কা দেখা দেয়।
প্রশ্ন: সম্প্রতি মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যাচ্ছে কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। এর মাধ্যমে কী আসলে ডলারের মূল্য নিয়ে দেশে যে অস্থিরতা তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে?
ড. আতিউর রহমান: কিছুটা দেরি হয়ে গেছে ক্রলিং পেগ চালু করতে। তবুও ডলারে এক ধাক্কায় ৭ টাকা বাড়ায় খানিকটা অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তবে এটি যেহেতু বাজার দরের প্রায় কাছাকাছি, তাই ধীরে ধীরে ডলারের দল স্থিতিশীল হয়ে আসবে। তবে এক্ষুণি প্রবাস আয় এবং রফতানি আয়ের ওপর দেয়া প্রণোদনা তুলে নেবার পক্ষে নই। আগে সামষ্টিক অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল হোক তারপরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আগে বেশি বেশি ডলার প্রবাহ বাংলাদেশ মুখী করা হোক।
প্রশ্ন: দেশের এনার্জি ও পাওয়ার সেক্টরের বেশিরভাগ উপকরণই আমদানি নির্ভর। এমতাবস্থায় দেশে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটলে দেশের এনার্জি ও পাওয়ার সেক্টরের উৎপাদনে প্রভাব পড়বে কী না? ডলার সংকট কেটে উঠতে কী ধরণের কৌশল সরকার নিতে পারে?
ড. আতিউর রহমান: ডলারের দাম বেড়ে যাবার প্রভাব জ্বালানি খাতে নিশ্চয়ই পড়বে। এখন যেহেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানির দাম ঠিক করা হয়, তাই তা বাড়বেই। ডলার সংকট বিনিময় হার বাজার নির্ভর করার কারণে ধীরে ধীরে কেটে যাবে। তবে শুরুতে হঠাৎ ডলারের দাম বেড়ে যেতে পারে খোলা বাজারে। পরে তা আনুষ্ঠানিক দরের কাছাকাছি চলে আসবে। আগের প্রশ্নের উত্তরে ডলার প্রবাহ বাড়ানো কিভাবে সম্ভব সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।
প্রশ্ন: দেশের মুদ্রাস্ফীতি ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য বড় ধরণের হুমকি কি না? মুদ্রাস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক,সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন আপনি?
ড. আতিউর রহমান: মূল্যস্ফীতি এখনও প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। মানুষ বেশ কষ্টে আছে। সহসাই মূল্যস্ফীতি কমবে বলে মনে হয় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেবার সুফল ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই পাবে বাংলাদেশ। তবে রাজস্বনীতিকেও সংকোচনমূলক হতে হবে। মনে হয় সেই দিকেই বাংলাদেশ হাঁটছে।
প্রশ্ন: মূল্যস্ফীতি কমাতে অন্যান্য দেশ সফল হলেও আমাদের দেশের সরকার তা পারছে না কেন? কোনো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি কি না?
ড. আতিউর রহমান: অন্যান্য দেশ সময় মতো মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করে এবং রাজস্বনীতিও রক্ষণশীল হবার কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে। আমরা দেরিতে হলেও সেই পথেই হাঁটছি। হয়তো আমাদের দেশেও তা কমবে। তবে খুব দ্রুত কমবে না। এই কষ্টটুকু আমাদের মনে হয় করতেই হবে।
প্রশ্ন: মানি লন্ডারিং রোধ এবং খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের দুর্বলতা আছে কি না?
ড. আতিউর রহমান: কিছু দুর্বলতা তো আছে। কিন্তু স্বল্প পরিসরে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আর প্রশ্ন কঠিন হলে উত্তর সহজ হবার সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান উদ্যোগ দৃশ্যমানভাবে কতটুকু ফলপ্রসূ বলে মনে করছেন? হুন্ডি রোধে আরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে কি না?
ড. আতিউর রহমান: এ বিষয়ে আগের প্রশ্নগুলোতে দেয়া উত্তরের দিকে খেয়াল করুন। এক দিকে হুন্ডির চাহিদা কমানো, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হার কাছাকাছি রাখা এবং রেমিট্যান্স পেমেন্ট অ্যাপ-ভিত্তিক করে মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকের সুযোগ বাড়ানো গেলে নিশ্চয়ই হুন্ডির পরিমাণ কমে আসবে।
রেদোয়ানুল ইসলাম
মন্তব্য করুন