ছবি-প্রতীকী
আমাদের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নতুন কিছু নয় বরং ভারত বিভাজনের পর থেকে এই অভিযোগ শুনতে শুনতে আমরা অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি। যদিও আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। তারপরেও শ্রেণি বিশেষের গরজ বড় বালাই। এসব বিভীষণরাই সামাজিক অপরাধ ও সমস্যাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে বানোয়াট অভিযোগের মাত্রাটা এখন সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। তারা এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগগুলোকে ভিত্তি ধরেই আবারো অখণ্ড ভারতের দিবাস্বপ্নে বিভোর। কিন্তু তাদের একথা মনে রাখা উচিত ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক একবার যখন ভেঙেছে তা আর জোড়া দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ, ভাঙা হাঁড়ি জোড়া দিলেও তা আর স্বাভাবিক হয় না বরং একটি ক্ষত থেকেই যায়। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের মাথায় রাখা উচিত।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় হিন্দু নেতৃত্বই ভারতকে অখণ্ড রাখতে চাননি। কারণ, এতে তাদের ক্ষমতা একচ্ছত্র থাকতো না। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এবং ন্যায়-ইনসাফের ভিত্তিতে ভারতকে অখণ্ড রাখা গেলে ভারতই এখন বৈশি^ক সুপার পাওয়ারে পরিণত হতো। কিন্তু হিন্দুবাদীরাই মুসলমাদের পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক একবার যখন ভেঙেই গেছে তখন পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে নিজেদের আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ভাই ভাই সংসার আলাদা হতেই পারে; কিন্তু ভ্রাতৃত্ব থাকতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একথা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মনে রাখা উচিত প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তার উত্তাপ থেকে নিজেদের ঘর রেহাই পায় না।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যত কথা বলা হয় সে সবের অধিকাংশই দুরভিসন্ধিমূলক ও হীন রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ। একটি মহল ক্ষমতার বাইরে থাকলে যেমন ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে অনুসঙ্গ বানায়; ঠিক তেমনিভাবে ক্ষমতায় থাকতে নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বিরোধীদের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতার পরিকল্পিত ও বায়বীয় অভিযোগ তোলে অবলীলায়। আর বাস্তবতা উপলদ্ধি না করেই সে পালে হাওয়া দেয়া হয় বাইরে থেকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদের দেশে কোন মানুষই বাস করে না বরং এদেশ ধর্মান্ধ পশুশ্রেণির চারণ ভূমি। মূলত, এই ইস্যুটি একটি ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বায়বীয়। যেসবের প্রায় ক্ষেত্রেই কোন সত্যতা নেই বরং মহল বিশেষের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার অংশ। যদিও কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতন বা সাম্প্রদায়িক ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়, চুলচেরা বিশ্লেষণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয়েছে মহল বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য বা হীন উদ্দেশ্যে এ ধরনের গর্হিত ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। আবার কখনো কখনো দেখা গেছে সামাজিক ও পারিপাশির্^ক সমস্যাগুলোকেও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। মূলত, বাংলাদেশে সংখালঘু নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা অভিযোগ প্রায় ক্ষেত্রেই বাস্তবভিত্তিক নয় বরং রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্র বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। এমনটিই প্রমাণিত হয়েছে বারবার; আর এখনো হচ্ছে।
মূলত, বাংলাদেশের মানুষ খুবই ধর্মপরায়ণ, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সহিষ্ণু, বন্ধুবৎসল ও অসাম্প্রদায়িক। তারা নিজেরা ধর্মভীরু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। আসলে ধর্ম বা বোধ-বিশ^াস নিয়ে এখানে কোন বিভাজন নেই। স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকারের নিশ্চয়তাসহ আমরা সকলেই বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তাই আমাদের দেশে সংখ্যালঘু বলে কোন কথা নেই। আমরা এই কনসেপ্টে বিশ^াসও করি না। ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে আমরা সকলেই গর্বিত বাংলাদেশী। আমাদের সংবিধানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১২(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, Any discrimination against or persecution of, person practicing a particular religion. অর্থাৎ ‘কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে’। সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদের বলা হয়েছে, The state shall endeavour ensure equality of opportunity to all citizens. অর্থাৎ ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকিবে’। সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদ বা অন্য কোন অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করা হয়নি। সঙ্গত কারণেই সাংবিধানিকভাবেই আমরা সকলকেই বাংলাদেশী। প্রত্যেক নাগরিক স্ব স্ব ধর্ম পালনে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন। কেউ ধর্ম পালন না করলেও সংবিধান তাকে ধর্ম পালনে বাধ্য করে না বা এজন্য তিনি কোনভাবেই বৈষম্যের শিকার হোন না।
আমাদের দেশে কোন সাম্প্রদায়িকতা না থাকলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যু সৃষ্টির একটি প্রবণতা রয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এক্ষেত্রে ঘরের শত্রু বিভীষণই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এর নানাবিধ কারণও রয়েছে। কেউ কেউ আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ ও হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যু সৃষ্টি করেন। কেউ আবার নিজের অপরাধকে গোপন বা শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য কতকগুলো স্বাভাবিক বিষয়কে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যু চড়িয়ে বসেন। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির লোক রয়েছেন যারা তুচ্ছ ঘটনা বা সামাজিক বিরোধকে সাম্প্রদায়িকতা বলতে রীতিমত পুলকবোধ করেন। দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অপরাধ প্রবণতাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয়। একশ্রেণির সুযোগ সন্ধানীরা চুন থেকে পান খসলেই সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া কিছুই চোখে দেখতে পারেন না। মূলত এরাই হচ্ছে চক্ষুষ্মান অন্ধ। এদের অপতৎপরতার কারণেই আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার অবক্ষয়ের তলানীতে এসে ঠেকেছে। একথা বাস্তব ঘটনার আলোকপাত করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ১৫ বছরের ওপরেই ছিল। বয়সের কথা এই জন্যই উল্লেখ করছি যে, তখন সে সময় সবকিছু বোঝার মত বয়স আমার হয়েছিল। একদিন আমার পাশের গ্রামের মেলায় ডাকাতির ঘটনা ঘটলো। জানা গেলো ডাকাতদের সাথে স্থানীয় জনগণের বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে। ঘটনাস্থলে গণপিটুনিতে ২ সহোদর সহ ৫ জন ডাকাতের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অনেকে গুরুতর আহত হয়েছে। সুদাম চন্দ্র মহন্ত নামের এক হিন্দু ডাকাত দল সদস্য ব্যাপকভাবে গণপিটুনি খাওয়ার সংবাদও পেলাম। লোকটি আমার নিকট প্রতিবেশী ছিল। দীর্ঘদিন পর জেলে থেকে জামিনে বেরিয়ে আসলো। কিন্তু সে পুরোপুরি সুস্থ ছিল না। আমরা প্রতিবেশীরা তার চাঁদা তুলে তার চিকিৎসাসহ পরিবারের খরচপত্র বহন করেছি।
অতীত পরিতাপের বিষয় যে, যে ঘটনায় গণপিটুনিতে ৫ জন মুসলিম ডাকাতের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে কোন কথা হলো না, হিন্দু ডাকাত সদস্যের গণপিটুনিকে সাম্প্রদায়িকতার রূপ দিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটানো হলো। বিষয়টি নিয়ে বিচার-সালিশও কম হলো না। শেষ পর্যন্ত এ বিচার গিয়েছিল দিল্লিতে। আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান। শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণেই তাকে তার অপরাধের দায় থেকে রেয়াত দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এমন একটি ঘটনাকেও সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হয়েছিল। যদিও গণপিটুনি দেয়ার আইনগত কোন বৈধতা নেই। কোন আত্মসচেতন মানুষ তা সমর্থনও করতে পারেন না।
এখানে আরেকটা ঘটনার উল্লেখ করলে বিষয়টি আলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেছিল। আর অভিযোগগুলো ছিল প্রায় ক্ষেত্রেই পরিকল্পিত। খবরের কাগজে অনেক সংবাদ স্থান পেলেও কোন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎ মেলার সৌভাগ্য অন্তত আমার মেলেনি। আমার নিজ এলাকায় অনেক হিন্দুর বসবাস হলেও তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতির কোন ঘটনা ঘটেনি। সে সময় কোন এক রেস্টুরেন্টে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এতে একজন হিন্দু হোটেল কর্মচারীসহ ৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পরের দিন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে চার দলীয় জোট প্রার্থীকে ভোট না দেয়ার কারণে বোমা মেরে হিন্দু হোটেল কর্মচারীর মাথা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই গুজবকে কেন্দ্র করেই অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ছিল না। মূলত, এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা। এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বিভীষণরা একটা নিছক দুর্ঘটনাকে সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে চালিয়ে দিয়েছিল।
আমাদের দেশে শুধু হিন্দুরাই বসবাস করেন না বরং বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ ও নানাবিধ উপজাতিসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর লোকজনও রয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে শুধু হিন্দুদের বিরুদ্ধে। হিন্দু ছাড়া অন্যকোন কথিত সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নির্যাতনের অভিযোগ কালেভদ্রেও পাওয়া যায় না। অথচ এসব ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। কিন্তু হিন্দুদের পক্ষে কথা বলার জন্য আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত থাকলেও তাদের ওপরই নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগ। আর আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী তো সবসময় তাদের পক্ষেই কথা বলেন। তুচ্ছ ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে সারাদেশেই ডামাডোল সৃষ্টি করা হয়। বিষয়গুলো অস্বাভাবিক ও রীতিমত রহস্যজনক। কারণ, অত্যাচারিত হয় দুর্বলরা। এক্ষেত্রে হিন্দুরা এদেশে কোন দুর্বল প্রতিপক্ষ নয় বরং ক্ষেত্র বিশেষে মুসলমানদের চেয়ে অনেক সবল। বিগত তিন মেয়াদে আওয়ামী-বাকশালী শাসনে এদেশে তো মুসলমানরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণও নেহাত কম নয়। বেশি দিনের কথা নয় চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ফরিদপুরে হিন্দু মন্দিরে প্রতিমায় অগ্নিসংযোগের কথিত অভিযোগে স্থানীয় হিন্দুরা মুসলিম দুই সহোদরকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। হিন্দুদের পিটুনিতে আরো কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। অভিযোগ সত্য হলেও এজন্য রাষ্ট্র, প্রশাসন ও আইন-আদালত রয়েছে। এক্ষেত্রে আইন হাতে তুলে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু স্থানীয় হিন্দুরা এই ঘটনা অজুহাত বানিয়ে দুই সহোদরকে হত্যাসহ কয়েকজন মুসলিম যুবককে যেভাবে নির্মমভাবে পিটিয়েছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো তদন্তে এই ঘটনার সাথে নিহত ২ সহোদরের সম্পৃক্ততা মেলেনি বরং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অভিপ্রায়ে ক্ষমতাসীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যোগসাজসে হিন্দুরাই অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাথে জড়িত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। এখন যদি ভিকটিম বা সংক্ষুব্ধরা প্রতিক্রিয়া দেখান বা আত্মরক্ষায় চেষ্টায় কিছু করে বসেন তাহলে সেটাকে কি সাম্প্রদায়িকতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে? অথচ এদেশে গীর্জা, প্যাগোডা ও গুরুদোয়ারাসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগের কোন অভিযোগ নেই। যত অভিযোগ শুধু হিন্দুদের ক্ষেত্রেই।
অপরাধ প্রবণতা শুধু আমাদের দেশে নয় বরং সবদেশেই কমবেশি রয়েছে। আর দক্ষিণ-পূর্ণ এশিয়া বিশে^র সর্বাধিক অপরাধ প্রবণ এলাকা। অপরাধী যেমন মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও তা থেকে মোটেই আলাদা নয়। কারণ, অপরাধ প্রবণতা সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। কিন্তু অতীত পরিতাপের বিষয় যে, কোন হিন্দুর অপরাধের জন্য তাকে যখন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারের মুখোমুখি করা হয় বা বিক্ষুব্ধ জনতা প্রতিক্রিয়া দেখায় তখন সেটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আর একটি চিহ্নিত ব্যক্তি তো ওত পেতে বসেই থাকে কিভাবে কোন স্বাভাবিক ও তুচ্ছ বিষয়কে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া যায়।
অপরাধীর কাজ হলো অপরাধ করা। এদের কোন জাত-ধর্ম নেই। যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই তারা অপরাধ করে বসে। এদের পরিচয়ই হলো এরা অপরাধী। চোর-ডাকাতরা মুসলমানের বাড়িতে যেমন চুরি-ডাকাতি করে, ঠিক তেমনিভাবে হিন্দু বা অন্যের বাড়ি হলেও ছেড়ে কথা বলে না। মুসলমানের বাড়িতে চুরি হলেও তা চৌর্যকর্ম হিসাবে আখ্যা পায়, আর হিন্দুর বাড়িতে চুরি হলে তা হয় সাম্প্রদায়িকতা। জমির সীমানা ঠেলা আমাদের দেশের একটা সামাজিক ব্যাধি। জীবন-জীবিকার কারণে জন্মস্থানের বাইরে থাকার কারণে আমার জমির সীমানা কোনটাই ঠিক নেই। এমনকি আমার বাড়ির জায়গার একটি বড় অংশ বেদখল হয়ে গেছে। এসব কাজ কোন হিন্দু বা অন্য কোন ধর্মেও লোক করেনি; করেনি কোন অনাত্মীয়ও বরং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাই এই দুষ্কর্ম করেছে। কিন্তু এমন কাজ যদি কোন হিন্দুর ক্ষেত্রে হয় তখন তা দুঃখজনক ও পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হয়। আর প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য, ছোটখাটো হাতাহাতির ঘটনা তো খুবই স্বাভাবিক। এসবের সাথে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতার কোনই সম্পর্ক নেই। অনেক সময় হিন্দুদের মধ্যেও বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু একই ঘটনা মুসলমানদের সাথে ঘটলেই বিভীষণরা তা সাম্প্রদায়িক হিসাবে প্রচার-প্রচারণা চালায়। প্রতিবেশীরাও বিষয়টিকে তিলকে তাল বানিয়ে বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বা সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। একই সাথে তারা মাঝে মধ্যেই সীমালঙ্ঘন করে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর খোয়াব দেখতে শুরু করে।
ধর্ষণ শুধু আমাদের দেশে নয় উন্নত বিশে^ও রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই প্রবণতা আমাদের দেশের চাইতে অনেকটাই বেশি। মাত্র কয়েকদিন আগেও তো প্রতিবেশী দেশ একজন চিকিৎসক ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের দেশের দিনাজপুরে পুলিশ সদস্য কর্তৃক শিশু ইয়াসমিন ধর্ষণ ও পরবর্তীতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তনু ধর্ষণ ও হত্যাসহ অনেক চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দেশে রয়েছে। দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যের প্রাণদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। আর এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই ঘটে থাকে। এটি একটি সামাজিক অপরাধ। কিন্তু কোন হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হলে তা ধর্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করে। পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িকতার রূপ দেয়া হয়। কিন্তু একথা একবারও ভাবা হয় না ধর্ষণসহ অপরাধ প্রবণতা সবদেশেই রয়েছে। এসবের সাথে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই।
একথা কারো অজনা নয় যে, চলতি মাসের ৫ তারিখের আগ পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর দেশে আওয়ামী বাকশালীদের অপশাসন-দুঃশাসন চলেছে। তারা ষড়যন্ত্রমূলক ও পরিকল্পিতভাবে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অবাধ গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রক্ষাকবজ জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন হয়েছে তার কোনটাই গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয় বরং ছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের চরদখলের নির্বাচনে। নির্বাচনে কোন স্বীকৃত বিরোধী দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া না হলেও একতরফা নির্বাচনও নিরপেক্ষ করতে পারেনি বাকশালীরা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও নির্বাচনের আগের দিন রাতে প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট বাক্স ভর্তি করার ঘটনা ঘটেছে। এতে জাতি হিসাবে আমরা লজ্জিত হলেও ভোটচোরদের কোন লজ্জা থাকতে নেই। তারা সে নির্বাচনকে ভিত্তি ধরেই ক্ষমতার ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছে।
মূলত, আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলে দেশে কোন সুশাসন ছিল না। ছিল না নাগরিকের কোন অধিকার। মূলত, বাকশালীরা পুরো দেশকেই রামরাজ্যে পরিণত করেছে। সাজানো ও পাতানো নির্বাচনে জনগণের মতামতের কোন প্রতিফলন ছিল না। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়াসহ হেন অপকর্ম নেই তারা করেনি। কেড়ে নেয়া হয়েছে গণমানুষের কথা বলার অধিকার। মাফিয়াতন্ত্রীরা দেশের জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে দলীয়কারণ করে ফেলে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠার নির্বাচন কমিশনকে পরিণত করা হয় দলদাস প্রতিষ্ঠানে। সুশাসনের অভাবেই সারাদেশে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারসহ হেন অপরাধ যে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা করেনি। কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে জাতীয় নেতাসহ বরেণ্য আলেমদের হত্যা করে দেশকে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়ে। আর এসবের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল আওয়ামী-বাকশালী সন্ত্রাসীরা। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশকে নিজেদের তালুক সম্পত্তি মনে করতে শুরু করে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক হিন্দু বা ভিন্নধর্মাবলম্বী থাকা অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে পুলিশের হিন্দু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকারের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও তিনি যেভাবে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতার মত বক্তব্য দিতেন এবং বিরোধী দলের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাতেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন যদি তাকে আইনের আওতায় আনা হয় বা ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিক্রিয়া দেখান তাহলে তা কি সাম্প্রদায়িকতা হবে? মূলত, এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই ছাত্র-জনতা একদফার আন্দোলনে নামে এবং এতে তারা পুরোপুরি সফলও হয়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পলায়নের পর সারাদেশেই কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনীর সতর্কতার কারণে তা একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন ছিল না। বিগত ১৬ বছরে যেসব আওয়ামী নেতাকর্মী জনগণের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গণরোষের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আমার আসনের মুসলিম এমপিকেও একেবারে তুলোধুনো করা হয়েছে। আমাদের সাবেক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন মাশরাফির বাড়িও তো এখন ধ্বংসস্তূপ। সে ধারাবাহিকতায় কোন হিন্দু আওয়ামী লীগ বা অন্য ধর্মের জুলুমকারী নেতাকর্মীর ওপর জনগণ যদি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাহলে তা কি সাম্প্রতিক ঘটনা বলার সুযোগ আছে? যদিও এ ধরনের ঘটনা একেবারে নেই বললেই চলে।
মূলত, বাংলাদেশের মানুষ খুবই ধর্মপ্রাণ ও অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু এদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তি। এদের অবস্থান হলো, ‘হাকীম হইয়া হুকুম কইরা পুলিশ হইয়া ধরো, সর্প হইয়া দংশন কইরা ওঁঝা হইয়া ঝাড়ো’। এরা পরিকল্পিতভাবেই দেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তোলে, নিজেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য উস্কানি দেয়। এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগই সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী প্রচার করে। বাদ বাকিগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও সামাজিক অপরাধ। এসবের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোন যোগসূত্র নেই। যারা হিন্দুদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি (Enemy Property) আখ্যা দিয়েছে তাদের মুখে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক। বাড়ি ভাঙে মাশরাফির আর নাম হয় লিটন দাসের।
আমাদের দেশে কোন সংখ্যালঘু নেই। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আমরা সকলেই গর্বিত বাংলাদেশী। আমরা একই মায়ের সন্তান। আমাদের জানমাল, ইজ্জত-সম্ভ্রম নিজেদের কাছে যেমন পবিত্র, তেমনিভাবে আমাদের অন্য ভাইদের জন্যও তাই। এদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। যারা এ ধরনের অপকর্ম করার চেষ্টা করবে তাদেরকে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবো। যেমন অতীতে করেছি, এখনো করছি এবং আগামী দিনেও করবো।
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
মন্তব্য করুন