• , |
  • ঢাকা, বাংলাদেশ ।
সর্বশেষ নিউজ
* জামায়াত নেতা আজহারের রিভিউ আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় * জ্বালানি তেলের দাম ১০-১৫ টাকা কমানো সম্ভব : সিপিডি * যুদ্ধ বন্ধ না হলে কোন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবেনা: হামাস * প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন এ এম এম নাসির উদ্দীন * সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের ৩৪৩ অ্যাকাউন্টে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ * দায়িত্ব নিয়েছেন নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী * শেখ হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না * আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বাহারুল আলম * সাবেক এমপি শাহজাহান ওমর থানা হেফাজতে * জামিন পেয়েছেন শফিক রেহমান

তিন শিশুর মৃত্যুরহস্য : অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধেও ভেজাল

news-details

ফাইল ছবি


ভেজাল অ্যানেসথেসিয়া ওষুধে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তিন শিশুর কানে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট বসানোর সময় তাদের অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়েছিল। সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের যে অ্যানেসথেসিয়া ওষুধ হিসেবে 'হ্যালোথেন' ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে হ্যালোথেনের উপাদানই ছিল না। অর্থাৎ এটা ভেজাল। এই রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এসেছে গতকাল। এ কারণে গতকাল জরুরি মিটিংয়ে বসে স্বাস্থ্য প্রশাসন। সেখানকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে ব্যবহূত ওষুধ পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ‘ইনহেলেশনাল অ্যানেস্থেটিক’ হিসেবে ‘হ্যালোথেন’ এর পরিবর্তে ‘আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেন’ ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে অ্যানেসথেসিয়জনিত মৃত্যু ও এর অপপ্রয়োগ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।

তবে এর আগে সারাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে অপারেশন করার সময় অনেক রোগী মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভেজাল হ্যালোথেনের কারণে। এটা গত বছরের ২৩ এপ্রিল থেকে হ্যালোফেন উৎপাদন ও বাজারজাত বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে এসিআই ওষুধ কোম্পানি এই ওষুধটি তৈরি করতো, যার নাম ছিল হ্যালোসিন। তারাও এটার উৎপাদন বন্ধ করেছে এক বছর ধরে। তবে পাশ্ববর্তী দেশ থেকে চোরাই পথে আসে এই হ্যালোথেন। যেটা ভেজাল ও নকল। এ কারণে খৎনা করাতে গিয়েও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। হ্যালোথেন ওষুধটি রোগীকে অজ্ঞান করতে ব্যবহার করা হয়। আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেনও রোগীকে অজ্ঞান করতে ব্যবহার হয়। এগুলো আলাদা ওষুধ হলেও মূল কাজ রোগীকে অজ্ঞান করা। একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ওষুধগুলো শরীরে প্রবেশ করালে রোগী অজ্ঞান হয়। সম্প্রতি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমদ এবং মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে আহনাফ তাহমীদ আলম আয়হাম নামে দুই শিশুকে খৎনা করানোর জন্য অজ্ঞান করার পর ওই দুই শিশুর মৃত্যু হয়। ওই দুই শিশুর মৃত্যুর পর দেশে সঠিক পদ্ধতিতে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন সামনে আসে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অবশেষে স্বাস্থ্য বিভাগের টনক নড়েছে। যারা ব্যবহার করছেন তারা এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। স্বজনহারা পরিবারগুলোর একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অর্ধহারা, অনাহারে জীবন পার করছেন। এসব দেখভাল করার দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। এছাড়া দেখভাল করার অনেকে আছেন। তারপরও ভেজাল হ্যালোথেন ব্যবহারে এতোগুলো মানুষ মারা গেল। খৎনা করাতে গিয়ে মারা গেছে। এর কারণ এই ভেজাল হ্যালোথেন। যেটা গতকাল প্রমাণিত হলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারাদেশে টিম পাঠিয়ে তদন্ত করে দেখেছে যে, সার্জন ঠিক আছে, অজ্ঞানকারী ডাক্তার ঠিক আছে ও অপারেশন থিয়েটার ঠিক আছে। তাহলে রোগী মারা গেল কেন? কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শিশুর মৃত্যুর পর সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের পক্ষ থেকে পরীক্ষার জন্য সায়েন্স ল্যাবরেটিতে হ্যালোথেন ওষুধটি পাঠায়। গতকাল তারা রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, অজ্ঞান করার ওষুধে হ্যালোথেন ছিল না। গতকাল এই রিপোর্ট বিএসএমএমইউ-তে আসে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর সত্যতা স্বীকার করেছে। সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টও একই তথ্য জানিয়েছে। সাধারণত চোরাই পথে আসা ভেজাল হ্যালোথেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ব্যবহার করা হয়। সরকারি হাসপাতালে ব্যবহার হয় না। বিশ্বব্যাপী হ্যালোথেন ৮০ থেকে ৯০ বছর ধরে ব্যবহার হয়েছে। গত এক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী এটি আর ব্যবহার হয় না। এখন নতুন ওষুধ হলো আইসোফ্লুরেন। আমাদের দেশে যে হেলোসিন তৈরি হয়, সেটার কাঁচামাল ভারত থেকে আসতো। গত এক বছর ধরে আর আসে না। এদিকে নতুন ওষুধ আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করার মেশিন আলাদা। নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে হলে মেশিনের কিছু পার্টস পরিবর্তন করতে হয়। অনেকে তা করে না। আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করার মেশিনের নাম হলো ভ্যাপোরাইজার। এটার মূল্য দুই লাখ টাকার বেশি। এ কারণে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক এটি কেনে না। বরং ভেজাল হ্যালোথেন ব্যবহার করছে। এ কারণে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। প্রতিটি আসল হ্যালোথেন এর দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর আইসোফ্লুরেন এর দাম ৬০০ টাকা।

সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সম্প্রতি লিখিতভাবে জানিয়েছে, অ্যানেসথেসিয়া ওষুধ ব্যবহার নিয়ে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। এ জন্য তারা সরকারের কাছে এর ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট আদেশ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। যদি হ্যালোথেন ব্যবহার করেন, তাহলে অরিজিনাল হ্যালোথেন ব্যবহার করতে হবে। তবে হ্যালোথেন কিংবা আইসোফ্লুরেন যেটিই ব্যবহার হবে, অবশ্যই তাকে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন থাকতে হবে। গতকাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে বিএসএমএমইউয়ে জরুরি মিটিং হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধ হিসেবে আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করতে হবে। ডিগ্রীধারী কোনো ডাক্তার ছাড়া কেউ অ্যানেসথেসিয়া দিতে পারবে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই সিদ্ধান্ত আগে নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারবার বলার পরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। লিখিত চিঠি দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। মন্ত্রণালয়ের এই অবহেলার কারণে কত মানুষ মারা গেছে সেই তথ্য কারোর কাছে নেই।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া অজ্ঞানকারী কোন ওষুধ ব্যবহার করতে পারবে না সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক। যদি কেউ ব্যবহার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি নির্দেশনা মেনে হাসপাতাল পরিচালনা করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, অ্যানেসথেসিয়ায় এখন থেকে হ্যালোথেন ব্যবহার করা যাবে না। আইসোফ্লুরেন ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে ভ্যাপোরাইজার থাকতে হবে। ডিগ্রিধারী ডাক্তার ছাড়া কেউ অ্যানেসথেসিয়া দিতে পারবে না। এই আদেশ সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট-এর সভাপতি সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, হ্যালোথেন এবং আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন একই ওষুধ। তবে হ্যালোথেন দামে একটু কম বলে ওষুধটি বেশি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে হ্যালোথেন আমদানি করত তারা এখন করছে না। তাই ওষুধটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, হ্যালোথেন আমরা ৪০ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু যারা আনতো তারা এখন আনছে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এটা অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে আনছে। এটার সঙ্গে অন্যকিছু মিশিয়ে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এজন্য আমরা এই ভেজাল ওষুধটি ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করেছি। এর পরিবর্তে মার্কেটে যেটা সহজলভ্য সেটা ব্যবহার করা যায়।

কী আছে নির্দেশনায়: স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব জসীম উদ্দীন হায়দার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে অ্যানেসথেসিয়ার কারণে কতিপয় রোগীর মৃত্যু ও আকস্মিক জটিলতা প্রতিরোধে এবং ব্যবহূত ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে অ্যানেসথেসিয়ায় হ্যালোজেন ব্যবহার ও এর বিকল্প নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। এছাড়া অ্যানেসথেসিয়াজনিত মৃত্যু ও ওষুধের অপপ্রয়োগ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে হ্যালোথেন, আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজারের সংখ্যা এবং এসব ভ্যাপোরাইজার পরিবর্তন করে আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার প্রতিস্থাপনে অর্থ বরাদ্দের প্রাক্কলন করতে হবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া হ্যালোজেন ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওই প্রজ্ঞাপনে।  এছাড়া দেশের সব সরকারি, বেসরকারি অবেদনকারীদের (অ্যানেসথেসিওলজিস্ট) নিয়ে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সব সরকারি হাসপাতাল থেকে বর্তমানে ব্যবহূত হ্যালোথেন ভ্যাপোরাইজারের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার প্রতিস্থাপনের জন্যে চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন মেশিন কেনার ক্ষেত্রে স্পেসিফিকেশন নির্ধারণে স্পষ্টভাবে আইসোফ্লুরেন, সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।


শহীদুল ইসলাম

মন্তব্য করুন