news-details

প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারি আইন ও সুশাসনের ধারণা

নাম - ছবি : সংগ্রহীত


গণপ্রশাসন দলীয়করণের অভিযোগ নতুন কিছু নয় বরং খুবই পুরোনো। যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন প্রশাসনকে নিজেদের আজ্ঞাবাহী করার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দলীয় আনুগত্যশীল লোকদের বসায়। প্রশাসনে এমন দলবাজ কর্মকর্তার কোন অভাবও হয় না বরং বৈষয়িক সুবিধা লাভের জন্য প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তা একেবারে মুখিয়ে থাকেন। কে কতখানি সরকারের ‘খয়ের খাঁ’ গিরি করে অনৈতিক সুবিধা নিতে পারেন তা নিয়ে একটা অশুভ প্রতিযোগিতাও শুরু হয় এসব দলবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে। যা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধের তৈল মর্দন পদ্ধতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে।


ক্ষমতাসীনদের সর্বাঙ্গে তৈল মর্দন করে এসব দলকানা আমলারা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে যত দোষ সরকারের ওপর বর্তায়। কারণ, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ বলে কথা। অনেক সময় সাবেক মন্ত্রীদের সদলবলে জেলেও যেতে হয়। কিন্তু এসব আমলারা থাকেন একেবারে ধরাছোয়ার বাইরে। মূলত এসব দলবাজ সরকারি কর্মকর্তারাই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিতে সমর্থ হন। অন্যদের ভাগ্যে জোটে একেবারেই ‘অশ^ডিম্ব’। দীর্ঘদিন প্রশাসনে চাকুরি করেও তাদের ভাগ্যের শিকে ছেড়ে না। আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোন সরকারই এই মুদ্রাদোষ থেকে মুক্ত ছিল না বা এখনও মুক্ত নয়। পার্থক্যটা শুরু মাত্রার রকমফেরের।


বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের অভিযোগটা বেশ জোড়ালো। অভিযোগ আছে যে, সরকার গণপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সহ সকল বিভাগকেই দলীয়করণ করে ফেলেছে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে দলবাজ ও দলীয় আনুগত্যশীল লোকদেরকে। সর্বোচ্চ বিচারালয়েও দলীয় লোকদের নিয়োগের অভিযোগটাও বেশ প্রবল। ফলে রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো প্রজাতন্ত্রের অংশ হলেও শুধুমাত্র শুধুমাত্র কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্বের অভাব ও দলীয় মনেবৃত্তির কারণেই নাগরিকগণ রাষ্ট্রের সেবা থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন। জনগণের জানমালের নিরাপত্তাবিধান গণপ্রশাসনের দায়িত্ব হলেও সংকীর্ণ দলীয় সংকীর্ণতার কারণেই আমাদের দেশের প্রশাসন এখনও গণমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। গণমানুষের সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ বিচার বিভাগের দায়িত্ব হলেও সরকারের অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের কারণেই বিচারবিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না এমন অভিযোগ খোদ সদ্য বিদায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতির। যা কোন ভাবেই উপেক্ষা করার মত নয়।


এমনিতেই অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগের অপব্যবহার করে অতীতের সকল সরকারই কমবেশী প্রশাসনকে আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মহড়া দিয়েছে এবং সে ধারাটা এখনও অব্যাহত আছে। আগামী দিনেও এই অপসংস্কৃতি চালু থাকবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সঙ্গত কারণেই জনপ্রশাসনের কাছ থেকে দেশের মানুষ কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। কারণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে মেধা, যোগ্যতা ও প্রজ্ঞাকে কোন ভাবেই প্রধান্য দেয়া হয় না বরং সে ক্ষেত্রে দলবাজীই প্রাধান্য পায়। তাই অতীতের কোন সরকারের আমলেই পুরোপুরি কল্যাণমূখী ও দলনিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। প্রশাসনকে ক্ষমতাসীনদের দলীয় ক্যাডার বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগটা বেশ জোরালো হয়েছে। কিন্তু হালে সে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যা আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।


প্রচলিত পদ্ধতিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও সে ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়। কিন্তু সম্প্রতি ‘সরকারি কর্মচারি আইন-২০১৭’ এ মহামান্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারে রাষ্ট্রপতির পছন্দের যেকোন ব্যক্তিকে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিত ও উপ সচিব নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হলে গণপ্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কোন প্রকার নিয়োগ বিধি অনুসরণ না করেই ক্ষমতাসীনদের ক্যাডারদের বসার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যাবে। প্রস্তাবিত আইনের ভাষ্য অনুযায়ি রাষ্ট্রপতি তার পছন্দের যেকোন ব্যক্তিকে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োগ দিতে পারবেন। যা শুধু অপরিণামদর্শীই নয় রীতিমত আত্মঘাতিই বলা চলে।


প্রস্তবিত এই আইনটি পাশ হলে প্রশাসনে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগের পরিসর ও সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোও সরকারেই বিলীন হবে। কারণ, এখন থেকে যে কোনো ব্যক্তিকে সরকারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে নিয়োগ দেয়া যাবে। রাষ্ট্রপতি তার বিশেষ এখতিয়ারে এ নিয়োগ দিতে পারবেন। এমন বিধান রেখেই সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৭ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করার কথা। এজন্য বিষয়টি বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ এখতিয়ার’ শিরোনামে প্রস্তাবিত আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে- ‘এই আইনের অন্যান্য বিধান, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে, বিশেষ মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও অপরিহার্যতা বিবেচনা করিয়া, সরকারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদসংখ্যার অনধিক ১০ শতাংশ পদে, উক্তপদে নিয়মিতভাবে নিয়োগযোগ্য কর্মচারীগণের বাহির হইতে, যে কোনো ব্যক্তিকে প্রেষণ বা চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ করিতে পারিবেন।’ এছাড়া অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রপতি, জনস্বার্থে, যে কোনো কর্মচারীকে, চাকরি হইতে অবসর গ্রহণের পর, প্রজাতন্ত্রের কর্মে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করিতে পারিবেন।’


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কোটায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকে সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিছু পদে রাজনৈতিক ব্যক্তিকেও নিয়োগের নজির রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগের বিধান প্রশাসনে দলীয়করণ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে। এটি কার্যকর হলে প্রশাসনের সর্বত্রই রাজনৈতিক ও পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আরও জোরালো হবে। বাড়বে দলীয়করণ। ফলে গণপ্রশাসন তার স্বকীয়তা হারাবে। কারণ, দলবাজ প্রশাসন কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। বিষয়টি সরকারের একটি অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ আখ্যা দেয়া হচ্ছে অভিজ্ঞমহলের পক্ষে থেকে। তারা বলছেন, ‘এতে প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়বে। ভেঙে পড়বে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড। মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সার্বিকভাবে দক্ষতার মান অবমূল্যায়ন হবে। ফলে প্রশাসনে মেধাহীনদের দৌড়াত্ব বাড়বে। দেশের জন্য এটি ইতিবাচক হবে না।’


মূলত , চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষমতা থাকার পরও রাষ্ট্রপতির বিশেষ এ এখতিয়ার প্রশাসনে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগকে উৎসাহিত করবে। এটা প্রশাসনের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। যাকে খুশি তাকে এনে প্রশাসনে বসিয়ে দেয়া যাবে। কারণ রাষ্ট্রপতিকে এ নিয়োগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় তার দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগের পরামর্শ দেবেন না। মূলত সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া যোগ্য ব্যক্তিদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রয়েছে। এর বাইরে রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও সরকারের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তবে এসব বিধান থাকলেও যত্রতত্র এর প্রয়োগ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।


বিষয়টি যে একেবারেই কাকতালীয়ভাবে হচ্ছে এমন নয় বরং বেশ সময় নিয়ে কীভাবে জনপ্রশাসনকে অজ্ঞাবাহী ও সেবাদাস বানানো যায় তার আটঘাট বেধেই সন্তর্পণে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। ২০০৬ সালে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নামে গণকর্মচারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় তদানীন্তন সরকার। কিন্তু তারা কোনো খসড়া করে যেতে পারেনি। কিন্তু সুযোগটাই লুফে নেই ১/১১ এর জরুরি সরকার। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সেনা সমর্থিত জরুরি সরকার আইনটির একটি খসড়া তৈরি করলেও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তা পাস করার জন্য রেখে যায়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা খসড়াকে যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করতে ২০১০ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তৎকালীন যুগ্ম সচিব (বিধি) মো. ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে খসড়া চূড়ান্ত করে ২০১১ সালের মার্চে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।


বিষয়টি মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। আইনের খসড়া নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রকৃচিসহ (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তার আগে সব ক্যাডার ও কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নিয়ে সংলাপ করার কথা বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ৩ জুন এবং ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়ায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিব নিয়োগের বিধান থাকার তীব্র বিরোধিতা করেন সব ক্যাডার কর্মকর্তারা। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেখানে উপস্থিত থাকা প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ঘোষণা দেন- সিভিল সার্ভিস আইন নয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য একসঙ্গে সরকারি কর্মচারী আইন প্রণয়ন করা হবে।


সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নজমুল ইসলামকে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রস্তবিত খসড়া জমা দিতে বলা হয়। নানা প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ২১ মে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই বছরের ৩ আগস্ট প্রস্তাবিত খসড়ায় অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। এর প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই প্রস্তাবিত খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সময় আইনের খসড়ার বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।


মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ পূরণ করতে গত বছরের এপ্রিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) আবদুল হাকিমকে প্রধান করে আবারও একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বিদ্যমান ৪৬টি আইন, বিধিমালা, অনুশাসন ও আদেশাবলীর প্রয়োজনীয় ধারা প্রস্তাবিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে ৭ পৃষ্ঠার খসড়া আইনটি ১৮ পৃষ্ঠায় রূপ নেয়। এতে ১৬ ধারার স্থলে ৬৭টি ধারায় পরিণত হয়। বিশাল এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রীসভায় উপস্থাপন করা হলে তা ফেরত পাঠানো হয়।


যাহোক এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ‘সরকারি কর্মচারি আইন-২০১৭’ বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও নিয়ম রক্ষা ছাড়া আইনটি পাশ হওয়ার শুধুই সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এই আইন পাশ ও প্রয়োগ গণপ্রশাসনে যে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে এতে কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। বিদ্যমান আইনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে যেভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে তাতেই প্রশাসনের ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। তার ওপর যদি নতুন আইন পাশ হয়ে কার্যকর হয় তাহলে গোটা দেশই ক্ষমতাসীনদের রামরাজ্যে পরিণত হবে।


রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর পৃথক কোন স্বত্ত্বা থাকবে না বরং সরকারের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। সরকারের দ্বারা কোন অধিকার ক্ষুন্ন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির প্রতিকার চাইবার কোন জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে নাগরিকগণ সরকারের দাসানুদাসে পরিণত হবে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হবে ভূলুন্ঠিত। যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সাথে তো সঙ্গতিপূর্ণ নয়ই বরং সভ্য সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথেও সাংঘর্ষিক। তাই এই আইন ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচর্চার পরিসর বৃদ্ধি করলেও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর অপমৃত্যুর সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর সার্বিক পরিস্থিতি বোধহয় সেদিকেই মোড় নিচ্ছে।


প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হয়ে কার্যকর হলে গণপ্রশাসন স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট হারাবে। বিদ্যমান আইনে প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, কর্তব্য নিষ্ঠা ও সততাকে প্রধান্য দেয়া হলেও নতুন আইনে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রদান করা হলে তা হবে উপেক্ষিত। কারণ, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়টাই বিবেচনায় আনা হবে। যা সিভিল সার্ভিস সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। সিভিল সার্ভিস বা স্থায়ী কর্মকর্তাদের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে অধ্যাপক ফাইনার ‘ ( Finer) বলেন, 'It is a professional body of officials, permanent, paid and skilled..’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ বলতে বুঝি সেই সুদক্ষ কর্মচারিবৃন্দ, যাদের কার্যকাল স্থায়ী, যার নির্ধারিত হারে বেতন গ্রহণ করেন এবং যারা বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও শিক্ষাপ্রাপ্ত।


প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি; সরকারের নন। কার্যকর রাষ্ট্র ও উন্নত বিশ্বে প্রশাসন দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করে। তাই কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রশাসনে চাকুরীর করার কোন সুযোগ থাকে না। ফলে নাগরিকরা তার সুফল পায়। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের যেভাবে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে ঘটবে তার পুরো উল্টোটা। দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পরিবর্তে প্রশাসনের শীর্ষপদ দখল করে নেবে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। অথচ প্রশাসনে রাজনৈতিক অন্তর্ভূক্তির সভ্য সমাজের কোথাও লক্ষ করা যায় না। আর তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞার মধ্যেও পড়ে না। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অগ্ (Ogg) বলেন, 'The body of the civil servants is an expert, professional, non-political, permanent and subordinate staff.' অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাবৃন্দ হবেন সুদক্ষ, পেশাদারী, অধীনস্ত কর্মকর্তা যারা স্বায়ীভাবে চাকুরি করেন এবং রাজনীতির সাথে যাদের কোন সংশ্রব নেই।


মূলত প্রস্তাবিত ‘সরকারি কর্মচারি আইন-২০১৭’ পাশ ও কার্যকর হলে গণপ্রশাসনে যে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। কারণ, প্রস্তাবিত আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশাসনকে দলীয়করণ করে আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান বানানো। ফলে দেশে যেমন আইনের শাসনের সংকট দেখা দেবে ঠিক তেমনিভাবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই এমন আত্মঘাতি আইন পাশ ও তার প্রয়োগ না হওয়ায় শ্রেয় মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
smmjoy@gmail.com


সম্পাদকীয়