news-details

সিন্ডিকেটের জয়-জয়কারে ভুগছে সাধারণ মানুষ

সিন্ডিকেটের জয়-জয়কার


সিন্ডিকেট শব্দটি আমাদের দেশে বেশি পুরনো না হলেও অবৈধ মজুদদারি, মুনাফাখোর, সুযোগের সদ্ব্যবহার করা, ভোক্তাকে জিম্মি করার রীতি দীর্ঘদিন ধরেই আছে বলে নথিপত্র বলে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাক্কালে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম যে সরকারি নির্দেশনা জারি করেন, তাতে বলা ছিল ‘কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, মজুদদারি, চুরি, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে; এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে’। 

দেশে চলছে সিন্ডিকেটের জয়-জয়কার। যে যেভাবে পারছে সিন্ডিকেটর মাধ্যমে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। এর সাথে জড়িত দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের সাথে ছোট বড় নানা ব্যবসায়ীরা। যা বিভিন্ন সময় প্রশাসনের অভিযানে ধরা পরেছে। কাঁচা বাজারে সিন্ডিকেট, মুদি-বাজারে সিন্ডিকেট। পেয়াজে সিন্ডিকেট, ডিমে সিন্ডিকেট। সড়কে সিন্ডিকেট, মার্কেটে সিন্ডিকেট। চাকরিতে সিন্ডিকেট, খেলাধূলায় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্র থেকে দেশ কবে মুক্তি পাবে এই প্রশ্ন কাকে করবো সেটাই বুঝছি না।

সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর চাল,ডিম সহ নানা পণ্যে সিন্ডিকেটের লাগামহীন খোলস বেড়িয়ে পড়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ার আগে থেকেই চালের মূল্য কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ছিল। আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। অথচ পরিবহণ ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি হিসাবে নিলে চালের দাম বাড়তে পারে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা। 

মজার ব্যাপার হলো, চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে অভিযোগের আঙুল উঠছে মূলত মিলারদের দিকে। আর মিল পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবহণ ব্যয়ের প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া বাজারে কোনো ঘাটতিও নেই; বরং বর্তমানে চাহিদার তুলনায় চালের মজুত ও সরবরাহ বেশি বলে জানা গেছে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, নানা অজুহাতে কারসাজি করে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে চালের দাম। এটি প্রতিরোধ করতে হবে যে কোনো উপায়ে। চাল এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। মানুষ তার মোট আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করে খাদ্য খাতে। এর মধ্যে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ চাল কিনতেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে থাকে। কাজেই চালের দামের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে মানুষের জীবনমান। এ অবস্থায় চাল নিয়ে কোনো ধরনের কারসাজি চলতে দেওয়া উচিত নয়।

সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করে:
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা গেছে সিন্ডিকেটের মূল কাজ হলোসরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা দেয়া৷ এটা করতে গিয়ে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেন এবং পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন৷ মূল কথা হলো বাজারে পণ্যের সরবারাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করা৷ বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে দিলেই দাম বেড়ে যায়৷ তবে এটা করতে হলে বাজারের বড় একটি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়৷ এটা আমদানি পণ্য এবং দেশি বিশেষ ধরনের পণ্য যা অল্প কিছু ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের পক্ষে করা সহজ৷

ডিমের মূল্য বৃদ্ধি:
ডিমের দাম হঠাৎ এত বাড়ল কেন? বাজারে ডিমের সরবরাহে ঘাটতি নেই। দেশে প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি ডিম উৎপাদন হয়, যা চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। উৎপাদিত ডিম বাজারে আসে, কিন্তু তা আসে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে। এ পর্যায়েই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি হয়। তারাই সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, দাম বাড়ায় বেশি মুনাফার জন্য। ভোক্তা অধিদপ্তর এদের ধরে না, তাদের অভিযান চলে খুচরা বাজারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্তরালে নিরাপদে থাকে। কেউ কেউ ডিমের দাম বাড়ার জন্য জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে বলছিলেন, ডিম পরিবহণের খরচ বেড়েছে। এটা একেবারেই খোঁড়া যুক্তি। ডিম উৎপাদনের খামারগুলো ঢাকা শহরের আশপাশে বা শহরতলিতে এবং শহরের খুব কাছেই সাভার, আশুলিয়া ও কেরানীগঞ্জে অবস্থিত। স্বল্প দূরত্বের এসব খামার থেকে ঢাকা শহরে ডিম পরিবহণের খরচ কতটাই আর বাড়বে। খুবই সামান্য। আমরা শহরে দেখি ডিম পরিবহণ হচ্ছে রিকশা ভ্যানে। রিকশা ভ্যান চালাতে জ্বালানি তেল লাগে না। দেশের অন্যান্য শহরেও একই পরিস্থিতি। মুরগির খাবার দেশেই তৈরি হয়, বিদেশ থেকে আসে না। তাহলে কোন যুক্তিতে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ৫০ টাকা বেড়ে গিয়েছিল? কোনো জবাব নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। 

এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ডিম নিয়ে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে সেটা স্পষ্ট। দাম নিয়ে যারা কারসাজি করেছে সে সব অসাধুদের খুঁজে বের করব।  এর পেছনে কে বা কারা আছেন তাদের কালোহাত যেন আর কখনো না বাড়তে পারে সেই ব্যবস্থাও নেবো। তিনি আরও বলেন, যখন জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে তখন একটি ডিমে ২০-৩০ পয়সা খরচ বেড়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম এক রাতে তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। এটা একদম অস্বাভাবিক। সরকার বিভিন্ন দিকে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিচ্ছে। এখন যদি আমদানি ওপেন করে দেওয়া হয় অনেকে পথে বসবেন। কিন্তু আপনারা সিন্ডিকেট করছেন। সে জন্য জনগণের কাছে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কোম্পানি ডিমের দাম অবৈধভাবে বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করেছে। আড়তদাররাও একই কাজ করেছেন। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনেই মজুতদারি, সিন্ডিকেট, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ এই আইনে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের বিধান আছে৷ তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? সরকারেই তো বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন৷ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তো সরাসরি ব্যবসা করেন৷ আর যারা সরকারে নেই তারাও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম৷ তাই সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে না৷ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়৷

তদারকি সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা ঝেড়ে আরও সক্রিয় হওয়া সময়ের দাবি
নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর তৎপরতা খুবই কম। এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েই চলেছে। বাজার তদারকি সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। সরকারও এদিকে নজর দিচ্ছে বলে মনে হয় না। নিত্যপণ্যের বাজারে শৃঙ্খলা এনে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন বাজার তদারকি সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি সক্রিয় করা এবং আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা। নিত্যপণ্যের বাজারে নৈরাজ্যের অবসান ঘটাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমনের বিকল্প নেই।


মো. হামিদুর রহমান