news-details

ইসলামে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার মূলনীতি

নাম - ছবি : সংগ্রহীত


ইসলামে খেলাধুলা ও শরীরচর্চাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি বরং শর্তসাপেক্ষে ও সীমিত পরিসরে ইসলাম তা অনুমোদন দিয়েছে। মূলত ইসলামে খেলাধুলাকে অবারিত করেনি বরং শরয়ী বিধিবিধানের আওয়াভুক্ত করে দিয়েছে। ইসলাম শর্তসাপেক্ষে শরয়ী বিধি-বিধানের আওতায় চিত্তবিনোদনকেও অনুমোদন দেয়। কিন্তু কথিত বিনোদনের নামে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতাকে বৈধতা দেয়া হয়নি। আসলে খেলাধুলা, বিনোদন ও শরীরচর্চার নামে ইসলাম বাহুল্য, অহেতুক সময় অপচয় ও জুয়াকে অনুমোদন করে না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ইসলাম কোন ধরনের ক্রীড়া, বিনোদন ও শরীরচর্চাকে অনুমোদন দেয় ? আমাদের দেশের প্রচলিত হাডুডু, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল, সাইকেল চালানো, টেনিস, সাঁতার কাটা, জগিং, হাঁটা ও দৌড়ানো এসব ইসলাম বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয় কি না ? এসব সর্বসাধারণ্যে অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন।


খেলাধুলা ও বিনোদন সম্পর্কে আলোচনা করার আগে আল্লাহ তায়ালার মানব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে আলোকপাত করা যেতে পারে। আসলে কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আল্লাহ আমাদেরকে এই ধরাধামে পাঠিয়েছেন সে সম্পর্কে আলোচনা হওয়া দরকার সবার আগে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা বাকারার ৩০ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘ ( হে নবী, স্মরণ করো) যখন তোমার মালিক (তাঁর) ফেরেস্তাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা বানাতে চাই’। মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত আদম (আ.) সৃষ্টির প্রাক মহুর্তে ফেরেস্তাদের কাছে এমন অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করেছিলেন।


এ থেকে ষ্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার খলিফা ও প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। তাই আল্লাহর আদিষ্ট পন্থার বাইরে কোন কিছু করার সুযোগ মানুষের নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বাব্বুল আলামীন আরও ইরশাদ করেছেন যে, আমি মানব ও জীন জাতিকে ইবাদত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি নি’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৫৬)। এ আয়াত থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, মানুষকে আল্লাহ শুধুমাত্র ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালন ও শরয়ী বিধিবিধানের আওতায় বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলও ইবাদাতের মধ্যেই গণ্য। তাই খেলাধুলা, আত্মবিনোদন ও ক্রীড়া-কৌতুককে শর্তহীন ভাবে বৈধ বলার সুযোগ নেই। যার মধ্যে আধ্যাত্মিক কল্যাণ এবং বৈধ পন্থায় জাগতিক স্বার্থ সংরক্ষিত নেই তা কোন ভাবেই বৈধ নয়। কারণ, ইসলাম কোন অহেতুক-বেহুদা কাজকে সমর্থন করে না।


নীচের আলোচনা থেকে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে। আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাষায় ইরশাদ করেছেন, “আমি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী কোনো কিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি, আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।” (সুরা দুখান : আয়াত- ৩৮, ৩৯)
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আকাশ পৃথিবী ও এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি ক্রীড়া উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম, তবে আমি আমার কাছে যা আছে তা দ্বারাই তা করতাম, যদি আমাকে করতে হতো।” (সুরা আম্বিয়া : আয়াত- ১৬, ১৭)
তিনি ইরশাদ করেন, “আমি নভোমন্ডল, ভূ-মন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী যা আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে। অতএব, পরম অবজ্ঞার সাথে ওদের খেলাধুলা উপেক্ষা করুন।” (সূরা হিজর : আয়াত- ৮৫) হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে রাসুল পাক (সা.) ইরশাদ করেন, “সমস্ত খেলাধুলা হারাম।” (মুস্তাদরেকে হাকিম)।


তবে যেসব খেলার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক স্বার্থ জড়িত আছে সেসব খেলা বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের ইজমা আছে। মূলত অতিপ্রাচীনকালে থেকেই বিশ্বের সর্বত্রই কুস্তি খেলার একটা রেওয়াজ চালু ছিল এবং এখনও সীমিত পরিসরে হলেও আছে। এই খেলার মাধ্যমে পরস্পরের শক্তি পরীক্ষার একটা সুযোগ থাকে এবং শারীরিক সামর্থ বৃদ্ধির এক প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে এই খেলাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। রাসূল (সাঃ) এর যুগেও এই কুস্তি খেলার প্রচলন ছিল। কোন এক যুদ্ধের আগে রাসুল (সা.) তার সেনাবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুকদের শারীরিক সামর্থ যাচাই এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মূল বাহিনী থেকে আলাদা করছিলেন। এদের মধ্যে রাফে ও সামারাহ নামক দুই কিশোরও ছিলেন। তাদেরকে যখন সেনাবাহিনী থেকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছিল, তখন রাফে তার পায়ের অগ্রভাগের ওপর ভর করে দাঁড়ালেন। যাতে তাকে লম্বায় প্রাপ্ত বয়স্কের মত বড় দেখায়। সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণও হয়েছিলেন এবং তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।


এই কৌশলের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পান। কিন্তু সামারাহ সেনাবাহিনীতে থাকার অনুমতি না পেয়ে রাসুল (সাঃ) এর কাছে গিয়ে বললেন, হে রাসূলুল্লাহর রাসুল (সা.)! রাফেকে যখন সেনাবাহিনীতে থাকার সুযোগ দিচ্ছেন তখন আমাকেও থাকার অনুমতি দিন । কারণ আমি তাকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় পরাজিত করতে পারি।' এ কথা শুনে রাসূল (সাঃ) তাদের দু'জনের মধ্যে কুস্তির আয়োজন করলেন। তুমুল লড়াইয়ের পর সামারাহ রাফেকে পরাজিত করলো। রাসুল (সা.) খুশী হয়ে তাকেও সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করলেন। এ থেকে বোঝা যায় ইসলামে পরস্পরের জন্য শক্তি পরীক্ষার জন্য কুস্তি খেলাকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। কিন্তু তা যদি উভয় পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করে বা পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক অবনতির কারণ হয় তবে তা কোন ভাবেই বৈধ হওয়ার সুযোগ নেই।


মূলত খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক বিষয়গুলোকে ইসলামে অতি সর্তকতার সাথে মূল্যায়ন করা হয়েছে। খেলা যখন খেলায় এবং বিনোদন যখন বিনোদনে সীমাবদ্ধ থাকে, তাতে মন্দ কোন বিষয়ের উপস্থিতি থাকে না, তখন ইসলাম এমন খেলা ও বিনোদনে বাধা দেয় না। কারণ খেলাধুলা সৃষ্টির আদিকাল থেকে শিশু-কিশোরদের মজ্জাগত ছিল ও আছে। এটা সর্বজন স্বীকৃত একটি বিষয়। কিন্তু যখন এটাকে শিশু-কিশোরদের থেকে কেড়ে নিয়ে কিংবা শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে ব্যবসায়িক রূপ দেয়া হয়, যুবক-যুবতী, নর-নারীসহ প্রাপ্ত বয়স্করা স্বীয় পেশা ও বৃত্তিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে মূল্যবান সময়ের একাংশ খেলায় এবং অপরাংশ খেলা দেখায় নষ্ট করতে দেখা যায়। এমন বাহুল্যকে ইসলাম কখনোই অনুমোদন দেয় না। তাই এই ধরনের খেলা, বিনোদন বা শরীরচর্চা যা-ই বলা হোক না কেন তা বৈধ হতে পারে না।


মূলত খেলাধুলার বিষয়টি শিশু-কিশোরদের মধ্যেই সীমারেখা টানা উচিত। খেলার নামে বা খেলা দেখার নামে প্রাপ্ত বয়স্কদের বেহুদা সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। শিশুরা স্বভাবগতভাবে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় শৈশব কাল অতিবাহিত করে। এটা স্বাভাবিক, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এর মধ্যে জুয়া থাকার কোন সুযোগ নেই। বস্তুত খেলাধুলা আবহমান কাল থেকেই আছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমানে নানা ধরনের খেলা, মেলা, জুয়া, লটারি আবিষ্কার হয়েছে। যেসব খেলা শরয়ী মানদন্ডে বৈধ হওয়ার সুযোগ নেই।


কারণ, এসব খেলাধূলা শরয়ী বিধানের আওতাভূক্ত থাকছে না বরং খেলাধুলা করার নামে বা খেলা দেখার নামে চলছে নারী-পুরুষ একত্রে উপবেশন থেকে নিয়ে কনসার্ট, গীতি, নাট্য, নৃত্যানুষ্ঠান, গান-বাজনা, খেলোয়াড়দের গোপন অঙ্গ, অর্ধনগ্ন উরু প্রদর্শনী, অশ্লিল গান ও বড় অংকের টাকায় খেলোয়াড় ক্রয়-বিক্রয়। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস ও বিভিন্ন লীগে অশ্লিলতা, নগ্নতা, জুয়া, মাদকাসক্ততা, দেহব্যবসা থেকে নিয়ে যে অপরাধগুলোর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, এতে সভ্য নাগরিক ও চিন্তাশালীরা এগুলোকে খেলাধুলা না বলে অপকর্ম বলাই ভালো বলে মনে করছেন।


ইসলামে নির্দিষ্ট কোন খেলাধুলাকে বৈধ বা অবৈধ বলা হয়নি বরং তিনটি শর্তের সাথে জায়েজ-নাজায়েজের সম্পর্ক করে দিয়েছে। ১. শারীরিক উপকার সাধন। ২. ইসলামি শরিয়াতের কোন বিধান লঙ্ঘন না হওয়া। ৩. আর্থিক ক্ষতিসাধন না হওয়া। এ তিনটি শর্ত যে খেলার মাঝে পাওয়া যাবে তা বৈধ, আর পাওয়া না গেলে অবৈধ। খেলা যে ধরনের বা যে পরিসরেরই হোক না কেন বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে এই তিন শর্ত অবশ্যই পূরুণ করতে হবে। অন্যথায় এসবকে বেহুদা কাজ হিসেবে গণ্য করতে হবে। তাই বৈধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই।


প্রাক ইসলামী যুগে খেলাধুলা, মেলা ও জুয়াভিত্তিক অনেক প্রকারের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। শরিয়াতের বিধান লঙ্ঘিত হওয়ায় অনেকগুলোকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। যার বর্ণনা কোরআন-সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রে বিদ্যমান । তবে শরীয়তের সীমারেখার ভেতরে উল্লেখিত শর্তের সাথে শরীর চর্চা, সাময়িক চিত্তবিনোদন, তীরন্দাজ, যুদ্ধকৌশল ও রণক্ষেত্রে জয়লাভের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক মহড়ার বৈধতা বিভিন্ন হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে পাওয়া যায়। তবে এগুলো খেলাধুলার অন্তর্ভুক্ত কি না এ নিয়েও পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক আছে। ইসলামের পরিভাষায়, খেলাধুলা ক্রিড়া-কৌতুক এমন সব কাজ-বস্তু বা বিষয়কে বলা হয় যা মানুষকে আল্লাহর এবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেল করে ফেলে। যার কোন উল্লেখযোগ্য উপকারিতা নেই কেবল সময় ক্ষেপন কিংবা মনোরঞ্জনের জন্য করা হয়।


খেলাধুলা ও কৌতকাবহ বস্তুর বর্ণিত সংজ্ঞার ভেতরে যত কাজ, যত কথা, বস্তু ও বিষয় ঢুকবে, সবগুলোকে শরিয়ত অনুমোদন দেয়নি। সুরা লুকমানের ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে, যারা লাহওয়াল হাদীস তথা খেলাধুলা-কৌতুকাবহ কথা ক্রয় করে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করার জন্য। আর এটা নিয়ে ঠাট্টাÑবিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবনামনাকর শাস্তি’। প্রথম লক্ষণীয় যে, কুরআন কেবল নিন্দার স্থলেই খেলাধুলা, ক্রিড়া-কৌতুকের উল্লেখ করেছে। এই নিন্দার সর্ব নিম্ন পর্যায় হচ্ছে মাকরূহ। আলোচ্য আয়াতটি খেলাধুলা ও অনর্থক কাজের নিন্দায় সুম্পষ্ট ও প্রকাশ্য। (রূহুল মাআনী, কাশ্শাফ)


‘আহকামুল কুরআনে’ বর্ণিত আয়াতের হুকুম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে ঐ সকল কথা, কাজ, বস্তু ও বিষয়কে হারাম করে যা মানুষকে আল্লাহ পাকের এবাদত ও তার স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়। তা গান-বাজনা হোক বা খেলাধুলা, ক্রিড়া-কৌতুক, মেলা, জুয়া সরঞ্জামসহ সবই এর অন্তর্ভুক্ত।


বর্ণিত আয়াতে অধিকাংশ তাফসীরের কিতাবে “লাহওয়াল হাদীস” এর ব্যাখ্যায় খেলাধুলা-ক্রিড়া-কৌতুক, আজে-বাজে কথাবার্তা, ছায়াছবি-নাটক, অশ্লীল উপন্যাস, কেচ্ছা-কাহিনী, গান-বাজনা ইত্যাদি যা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেলা করে তা হারাম সাবস্ত করেছেন। বিখ্যাত ফিকহ শাস্ত্রীয় কিতাব ‘হেদায়া’র ভাষ্যমতে, চৌদ্দ গুটির খেলা মাকরুহে তাহরীমী। কারণ এর দ্বারা জুয়া খেলা খেললে তা হবে মাইসির। আর মাইসির অকাট্য হারাম; পবিত্র কোরআন হাদীসের আলোকে।


মাইসির হচ্ছে যে কোন জুয়া খেলার নাম। আর যদি এর দ্বারা জুয়া না খেলে তাহলে এটা হবে নিরর্থক লাভহীন এক কাজ। ‘দুররে মুখতার’ গ্রন্থকার বলেছেন যে, কোন খেলাধুলা বৈধ হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে, তাতে হার জিতের ওপর কোন বাজি ধরা যাবে না। জুয়ার চুক্তি করা যাবেনা। খেলার অধ্যবসায় সদা-সর্বদা করা যাবেনা। জীবনের আদর্শ উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট হিসেবে একে আজীবন করা যাবেনা। খেলাধুলার কারণে ইসলামের অনুশাসন বাস্তবায়ন কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি হতে পারবে না। অন্যথায় তা হারাম হওয়ার বিষয়ে ফকীহ ও আলিমগণ একমত।


সীমিত পরিসরে খেলাধুলা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হাদিসের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূল সা. পবিত্র মদীনায় খেলাধুলায় মগ্ন একদল ছেলেদের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আর আমি তাঁর কাঁধদ্বয়ের ফাঁক দিয়ে তাদের খেলা দেখলাম। রাসুল (সা.) বললেন, খেলাধুলা কর হে আরিফের বৎসগণ! এতে ইয়াহুদি ও নাসারাগণ আমাদের শরীয়তে আনন্দোদ্দীপনার সুযোগ আছে বলে জানতে পারবে। ছেলেরা বলতে লাগলো ধন্যবাদ আবুল কাসিম, ধন্যবাদ। ইতোমধ্যে হযরত ওমর রা. আসায় সকলে মাঠ ত্যাগ করে চলে গেল।


আরেক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, তিন খেলাই মুসলমানদের (৩টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ) এক. আপন স্ত্রীর সাথে অত্যাধিক প্রেমভরে খেলা করা। দুই. স্বীয় অশ্বকে যুদ্ধ কৌশল শিক্ষা দেয়া। তিন. শত্রুর মোকাবেলায় জয় লাভের জন্য তীর ছুড়া ছুড়ির প্রশিক্ষণ। (তিরমিজী, আবু দাউদ, ইবনে মাযা) কানজুল উম্মাল নামক কিতাবে আরেকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, (তোমরা মাঝে মধ্যে) খেলাধুলা কর, কারণ আমি তোমাদের জীবন ব্যবস্থায় সম্প্রীতির অভাব অপছন্দ করি।


ঈমাম আবু দাউদ স্বীয় মারাসীল গ্রন্থে এক হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, মাঝে মধ্যে মনকে আরাম দাও, অবকাশে থাক। জামে ছগিরের এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, আল্লাহর যিকির-আযকার ব্যতীত যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান খেলাধুলার অন্তর্ভূক্ত।
খেলাধুলা জায়েজ-নাজায়েজ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কেরামগণ বলেছেন, ইসলামী শরীয়তে নির্ধারিত কোন খেলাধুলা নেই। সেই সাথে নির্ধারিত কোন নিয়ম কানুনও নেই। বরং দ্বীন ইসলাম, ব্যক্তির শারীরিক ও আর্থিক স্বার্থ বিরোধী খেলা এবং জুয়া ভিত্তিক যাবতীয় খেলাধুলা নিষিদ্ধ ও হারাম। মোটকথা খেলাধুলা হারাম হওয়ার কারণ সমূহের মধ্যে থেকে প্রধান কারণ হিসেবে যে ক’টিকে সনাক্ত করে বৈধ বা অবৈধ হুকুম লাগিয়েছেন তা নিম্নরূপ-


(ক) দু’তরফা লেনদেন ও হার জিতের বাজি খেলা বা জুয়া খেলা করা। (খ) আল্লাহর জিকির-আযকার ও তার স্মরণ থেকে মানুষকে গাফিল করা। (গ) বেশিরভাগ অধার্মিক ও অসাধু লোকজনের আড্ডা জমে উঠা। (ঘ) খেলার অধ্যবসায় সদা-সর্বদা করা। (ঙ) শারীরিক ক্ষতি সাধিত হওয়া। (চ) আর্থিক ক্ষতি সাধন হওয়া। এগুলো যে খেলায় পাওয়া যাবে সেটা হারাম ও নিষিদ্ধ আর না পাওয়া গেলে বৈধ।
হাদিসের বিখ্যাত কিতাব ‘মুসতাদরেকে হাকিম’এ হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সর্বপ্রকার খেলাধুলা হারাম। তিনটি বিষয় খেলাধুলার অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন, ১. তীরধনুক চালনা করা, ২. অশ্বকে প্রশিক্ষণ দান করা, ৩.নিজ আহলিয়ার সাথে শরীয়ত সম্মতভাবে হাস্যরস করা।’
এছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মু’মিনের শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ হচ্ছে সাতার কাটা,আর নারীর শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে সূতা কাটা।’ যত প্রকার খেলা রয়েছে তার প্রত্যেকটির মধ্যেই না কোন দ্বীনি ফায়দা রয়েছে এবং না কোন দুনিয়াবি ফায়দা রয়েছে। বরং প্রতিটি খেলা তিনটি অবস্থার কোন এক অবস্থা থেকে খালি নয়। হয় তা কুফরী হবে অথবা হারাম হবে, আর না হয় তা মাকরূহ হবে। যেখেলা বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয় অথবা দ্বীন ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয়, তা সম্পূর্ণ কুফরী।’


শরীয়তে যে সমস্ত বিষয়গুলোকে জায়িজ বলা হয়েছে বা অনুমোদন করা হয়েছে, সে সমস্ত বিষয়গুলোতে যেমন দ্বীনি ফায়দা রয়েছে, তেমনি দুনিয়াবী ফায়দাও নিহিত রয়েছে। যেমন, তীর চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সাতার কাটা, দৌড় অনুশীলন ইত্যাদি জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাস্থ্যকে সুঠাম ও বলিষ্ঠ রাখার কারণ। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “কোন ব্যক্তির জন্য দ্বীনের সৌন্দর্য হলো, অহেতুক বা অপ্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা।’(তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, মুয়াত্তা) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই (সর্বপ্রকার)অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সূরা বণীইসরাঈল, আয়াত-২৭)


ব্যায়াম বা শরীরচর্চাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু এসবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট হতে হবে। শুধুমাত্র ব্যায়াম বা শরীরচর্চার নামে বিধর্মী, বিজাতি ও বেদ্বীনদের দ্বারা প্রবর্তিত কোন খেলায় বৈধ হতে পারে না। কারণ, এসব খেলার মধ্যে জুয়া, সময় অপচয় ও বেহুদা বিষয়গুলো বিদ্যমান। কারণ,ব্যায়ামের জন্য হাদিস শরীফে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন তীর চালনা করা, অশ্বকে প্রশিক্ষণ দেয়া, সাতার কাটা, দৌড় অনুশীলন করা ইত্যাদিই যথেষ্ট। আর বিনোদন, সেটা যদি নাজায়িজ পদ্ধতিতে হয় তাহলে যত সামান্যই হোক তাও সম্পূণর্ অবৈধ -হারাম।


বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, ইসলামে শারীরিক উপকার সাধন, ইসলামি শরিয়াতের কোন বিধান লঙ্ঘন না হওয়া ও আর্থিক ক্ষতিসাধন না হওয়া-এই তিন শর্ত পূরুণ ছাড়া কোন খেলাকে জায়িজ বা বৈধ বলার সুযোগ নেই। শরীয়ত-এর উছুল হচ্ছে- হারামকে হালাল বলা, হারাম কাজে খুশি প্রকাশ করা, হারাম কাজে উৎসাহিত করা ও সাহায্য সহযোগিতা করা হারাম ও নাজাযায়জ; যা ঈমান নষ্টের কারণ। তাই সকল মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে-হারাম যাবতীয় খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও বিনোদনের নামে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা এবং এতদসংশ্লিষ্ট সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা।


শরীরকে সুস্থ এবং মনকে নির্মল রাখতে হলে নিয়মিত শরীর চর্চা অর্থাৎ ব্যায়াম করতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, শিশুকাল থেকে শুরু করে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সবারই শারীরিক সুস্থতার জন্য ব্যায়াম করা দরকার। একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে ইসলামেও শরীর চর্চার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। এছাড়া তিনি নির্দোষ খেলাধুলা, ঘোড়দৌঁড়, কুস্তি ও তীর নিক্ষেপ চর্চার জন্য অন্যদেরকে উপদেশ দিতেন। তিনি বলেছেন, পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো হলো, পিতা সন্তানকে লেখাপড়া, সাঁতার ও তীর-চালনা শেখাবে।


শারীরিক শক্তি আল্লাহতায়ালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এজন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেন-‘যে ঈমানদার ব্যক্তির শারীরিক শক্তি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর নিকট প্রিয়।' কারণ ইবাদত করার জন্য শারীরিক শক্তি প্রয়োজন। আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্যও শক্তি প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য অর্থ-সম্পদের চেয়ে স্বাস্থ্যই বেশী মূল্যবান। রাসূল (সাঃ) পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর পূর্বে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছেন। এগুলোর একটি হলো, রোগাক্রান্ত হবার পূর্বে স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে মানবদেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বার্ধক্য আসার পূর্বেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। এ জন্য শরীরের প্রতি যত্ম নেয়ার প্রতি রাসুলে খোদা গুরুত্ব দিয়েছেন। এক সাহাবী সারাদিন রোজা রাখতেন আর রাতভর নামাজ পড়তেন। রাসূল (সাঃ) তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘নিশ্চয় তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে।'


মোটকথা যেসব খেলা, শরীরচর্চা ও বিনোদনের মাধ্যম শরয়ী মানদন্ডে উত্তীর্ণ ইসলাম সে সবকে কোন ভাবেই নিরুৎসাহিত করেনি। যেসব খেলাধুলার মধ্যে পরলৌকিক ও ইহলোকিক কল্যাণ নিহীত থাকবে, কোন ভাবেই শরয়ী বিধিবিধান লঙ্ঘিত হবে না এবং আর্থিক বা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না সেসব খেলা অবশ্যই বৈধ। ইসলামে শরীরচর্চা ও বিনোদনের বিষয়টিও সংবিধিব্ধ বদ্ধ। তাই শরীরচর্চা ও বিনোদনের নামেও স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। তাই শর্তসাপেক্ষে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা বৈধ।


সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

smmjoy@gmail.com


এনএনবিডি ডেস্ক