ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীতে নানা ঘটনাকে স্মরণে রাখতে পালন করা হয় ভিন্ন ভিন্ন দিবস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতার জন্য দিবসগুলো পালন করা হয়। তেমনি গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস আজ (৩০ আগস্ট)। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন ফর প্রোটেকশন অব অল পার্সনস এগেইনস্ট এনফোর্স ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়, তাতে ৩০ আগস্টকে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) হিসাবে, বাংলাদেশে এ রকম এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি। যারা গত ১৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার হয়েছেন।
হংকংভিত্তিক এই সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন বা পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৩৮৩ জনকে। আর তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শুরু থেকেই গুমের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমনও বলা হয়েছে যে এসব ব্যক্তি নিজেরাই আত্মগোপন করে আছেন, হারিয়ে গেছেন বা ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে।
বাংলাদেশে গুমের শুরুটা বেশ আগের। গুমের অভিযোগ পুরোনো হলেও বিএনপি প্রথম তাদের নেতা চৌধুরী আলমকে ঢাকা গুম করার অভিযোগ তোলেন। এরপর ২০১২ সালে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর বিষয়টি দেশে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এসব সমালোচনার মধ্যেই গুমের বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে বাড়তে থাকে এর পরিধি।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি নিয়ে বেশ আলোচনা হতে থাকে। কিন্তু তবুও কমেনি গুমের পরিসর। দৃশ্যঃত, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে গুমের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।
বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচন সামনে রেখে এবং নির্বাচন–পরবর্তী আন্দোলন ঠেকাতে বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের তুলে নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগের তিন বছরও গুমের অভিযোগ বেশি ছিল।
দেশে গুমের শিকার এর পরিবারগুলোর সদস্যদের অনুভূতিও ভিন্ন ভিন্ন। কেউবা এখনো জানতে পারেননি কেন তার ভাই কিংবা সন্তান অথবা বাবাকে গুম করা হয়েছে। তারা আদৌ জীবিত না মৃত সেই ধারণাও তারা করতে পারছেন না। এরকম ঘটনার শিকার শুধু বিএনপির নেতা-কর্মী নন, সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিও গুমের শিকার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার ভাটারা এলাকার একটি বাসা থেকে রামপুরা থানা ছাত্রলীগের নেতা মোয়াজ্জেম হোসনকে (অপু) সাদাপোশাকে তুলে নেওয়া হয়।
মানবাধিকার সংগঠন এএইচআরসি ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা তুলে ধরেছে।
এএইচআরসির তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৯ জন ও ২০১১ সালে ৩২ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ২০১২ সালে ২৭ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জনের তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৯০ জন এবং ৯৮ জনকে গুম করা হয়েছিল ২০১৮ সালে।
গুমের অভিযোগগুলো নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা না করে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে—দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এমন নানা বক্তব্য দিয়ে আসল ঘটনা পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন।’
বাংলাদেশে গুমের শিকার ৭৬ জন ব্যক্তিদের একটি তালিকা করে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। গত বছরের ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক তৎকালীন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকা সফরের সময় এ তালিকা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। মিশেল ব্যাশেলেতের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ার্কিং গ্রুপ ৭৬ জনের যে তালিকা দিয়েছে, তাদের মধ্যে ১০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকিদের মধ্যে ১০ জনকে খুঁজে পেতে পুলিশ সহযোগিতা করতে চাইলেও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। বাকি ৫৬ জন ‘পলাতক’ বা নিখোঁজ।
তখন মিশেল ব্যাশেলেত ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন।
জাতিসংঘ ওই তালিকা দেওয়ার পর গত বছরের জানুয়ারিতে সেই তালিকা ধরে খোঁজখবর শুরু করে পুলিশ। তখন গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাসায় বাসায় গিয়ে স্বজনদের জেরা করা, থানায় ডেকে পাঠানো ও সাদা কাগজে সই নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ ওঠে। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গুমের শিকার পরিবারকে হয়রানি করতে নয়, ঘটনা তদন্তে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে যান পুলিশের সদস্যরা।
জাতিসংঘের তালিকা ধরে গত বছর যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তার অগ্রগতি ও সর্বশেষ পুলিশের তালিকায় কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তাও গণমাধ্যমের কাছে কিংবা জাতীয়ভাবে স্পষ্ট করা হয়নি।
নিজস্ব প্রতিবেদক :