news-details

পরিবর্তিত দেশে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ফাইল ছবি


ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ৫ই আগষ্ট একটি নাম, একটি নাটকীয় ইতিহাস। দেশকে ষড়যন্ত্রের কবল থেকে উত্তোরণের গণ জাগরণ ও গণ অভ্যুত্থান। যা কোন কালে মানুষ ভুলবেনা। এতো অল্প সময়ে হাজারো মায়ের কোল খালি করা মর্মস্পর্শী রক্তাক্ত আখ্যান ভাস্মকর হয়ে থাকবে শতাব্দীকাল।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব আন্দোলনে বিগত সাড়ে পনের বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। তাঁর পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগের খবর শুনে খুশিতে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার আসে সমগ্র বাংলার পথেপ্রান্তরে। সেদিন কোটি কোটি মানুষ পতাকা হাতে, রাস্তায় নেচে গেয়ে, শ্লোগানে শ্লোগানে উন্মাতাল হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরে এমন দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। হাসিনা সরকারের পতনে মানুষ যেন তার হারানো বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। এ পতনে মানুষ যেন তার হারানো গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছে, ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছে। মানুষ যেন গুম, খুন, আয়নাঘরের বিভৎসতা থেকে নিস্তার পেয়েছে। শেয়ার বাজার ধসের রাহু গ্রাস আর ভয়াবহ দুর্গতি থেকে মুক্তি পেয়েছে। মানুষ আনন্দ উদযাপন করছে যে যার মতো! শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে জনগণ ডানা মেলে আকাশে উড়ছে! এমন খুশির দিন বাংলাদেশে আর আসবে কিনা সন্দেহ! প্রবল জনতার ঢেউয়ে নব্বইয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন দেখেছে এদেশের মানুষ। সেসময়ে রাজপথে বিভিন্ন দলের আনন্দ শ্লোগান আমরাও দেখেছি কিন্ত এইবারের মতন এত বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ¦াস বাংলার এই মাটি আর কখনো সাক্ষী হয়নি। প্রতাপশালী স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ইতিহাস বিশ্বে ভূড়ি ভূড়ি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। ইতিহাস থেকে এঁরা কখনো শিক্ষা নেয় না। ক্ষমতায় থাকলেই সম্মান আর জনপ্রিয়তা যে বাড়ে না, তারা তা বুঝতে চায় না। তারপরেও ক্ষমতার নেশায় স্বৈরাচার হওয়ার দৌঁড়ে থাকে বহু রাষ্ট্রনায়ক। অতীতে হিটলার, মুসোলিনী, স্ট্যালিন, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, সাদ্দাম হোসেন বা গাদ্দাফীর মতো বড় বড় স্বৈরাচারের ইতিহাস আমরা পড়েছি। সবার পরিণতি ছিল করুণ। শেখ হাসিনারও পতন ছিল একই প্রকৃতির। ক্ষমতা ছাড়ার পরে বাংলাদেশের কোন সরকারপ্রধানের এমন করুণ দশা হয়নি। বিগত তিনটি ইলেকশনে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে ভোটারকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল শেখ হাসিনা। বিগত সাড়ে পনেরটি বছর বিএনপিসহ অন্যান্য মাঠের বিরোধী দলগুলোর মাঝারী আকারের আন্দোলন সংগ্রামকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রায় বিনাবাঁধায় রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মামুলি কোটা আন্দোলন যে সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে তা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি। তাঁর হঠাৎ পদত্যাগ ও দেশত্যাগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একপ্রকারের বিপদে পড়ে গেছেন।

 ঘটনার সূত্রপাত, ২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা আন্দোলন আবার নতুন করে আলোচনায় আসে। শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহবাগে সভা-সমাবেশের মধ্যে এই আন্দোলন চলমান থাকলেও ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে আন্দোলনের গতি প্রকৃতি হঠাৎ অন্যদিকে বাঁক নিতে থাকে। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর এমন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে?’ প্রথমে দিকে ‘সরকার, সরকার’ বললেও পরবর্তীতে ‘স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ বলে গগনবিধারী স্লোগান দিতে থাকে। এর পরদিন ১৪ জুলাই সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী এবং আওয়ামীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ‘মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ভঙ্গকারী’ হিসেবে অভিযোগ করেন। একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের মোক্ষম জবাব দেওয়ার জন্য ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন। তারপরের দিন ঢাকা, অর্থাৎ ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এবং ভিসিভবনের সামনে ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্রেসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাথে পুলিশও শিক্ষার্থীদের উপর ছররাগুলি, রাবারবুলেট, টিয়ারগ্যাস সহকারে আক্রমণ করেন। ছাত্রলীগ এবং পুলিশের আক্রমণ এমন তীব্র ছিল যে, এতে বহু ছাত্র-ছাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন। ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী নিজ দল থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই দিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্র সমন্বয়ক আবু সাইয়িদ মাত্র ২০-২৫ হাত দূর থেকে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলে আগ্নেয়গিরির স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ঐ দিন সারাদেশে ৬ জন নিহত হন। পুলিশ ও দুস্কৃতিদের গুলিতে চট্টগামেও সেইদিন ৩ জন প্রাণ হারান। সেদিন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদল নেতা মো. ওয়াসিম আকরাম শহীদ হন। ১৮ ও ১৯ জুলাই প্রাণ যায় যথাক্রমে ৪২ ও ৮৫ জন শিক্ষার্থীর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপকতা বেড়ে গেলে ১৯ জুলাই থেকে দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করে কারফিউ জারী করে। ২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ও সরকারী চাকুরীতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩% নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরকারের এই প্রজ্ঞাপনকে প্রত্যাখান করে ২৯ জুলাই শত শত শিক্ষার্থীর মৃত্যু, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আহত হওয়া ও গ্রেফতারের কারণে সরকারের কাছে নয়দফা দাবী পেশ করেন এবং সরকার কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখান করেন। নয়দফা দাবীর মধ্যে প্রধান দাবী ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। আইনশৃঙ্খলা, দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগের আলটিমেটাম প্রদান করেন। এবং সাথে আরো কিছু দাবী দাওয়া দ্রæত মিটিয়ে ফেলার জন্য সরকারের নিকট আহবান করেন। উপরের দাবীগুলোর ব্যাপারে সন্তোষজনক সমাধান না হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা ৩ আগষ্ট শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে ১ দফা তথা সরকারের পদত্যাগ দাবী করেন সাথে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে টিকতে না পেরে অবশেষে ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সি-১৩০জে এয়ারক্রাফট যোগে দেশ ছাড়েন। তিনি আগরতলা হয়ে দিল্লীর কাছে গাজিয়াবাদে হিন্দন এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। সাথে ছিলেন শেখ রেহানাও। তাঁরা বর্তমানে দিল্লীর একটি অতিথিশালায় আছেন। প্রসঙ্গত, পদত্যাগ এবং দেশ ছাড়ার জন্য শেখ হাসিনা মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পান। ৫ আগষ্ট বিকাল ৪টায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার ইস্তফা দেওয়ার বিষয়টি দেশবাসীকে অবহিত করেন। মূলত দেশের ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীর সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে আরো বহু লাশের মিছিল থেকে দেশ বেঁচে গেছে। সেনাবাহিনী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে ব্যর্থ হলে দেশে রক্তবন্যার পাশাপাশি সিভিল ওয়্যার লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

 বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কমপক্ষে এক হাজারের বেশি জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৪-৬ আগষ্ট এ তিন দিনেই নিহতের সংখ্যা পাঁচ শতের বেশি। এমন শিক্ষার্থী ও মানুষের মৃত্যু অতীতে বাংলাদেশের কোন আন্দোলনেই হয়নি। স্বাধীনতা আন্দোলনকে বাদ দিলে আন্দোলনের তীব্রতা অতীতের সকল আন্দোলনকে ছাড়িয়ে গেছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পরে সর্বশেষ গত ৮ আগষ্ট বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রধান উপদেষ্টাসহ এ পর্যন্ত মোট ২১ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। উপদেষ্টা হিসেবে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বকারী নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও আছেন। সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়েছে। তাই সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। পনের বছরের বেশী একটিমাত্র দল ক্ষমতা থাকার কারণে বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পুলিশ বিভাগে। মূলত পুলিশী রাষ্ট্র গঠন করেই বিরোধী দলকে নির্মমভাবে গুম, খুন, দমন পীড়ন, জেল-জুলুম, গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিগত দেড়দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন ছিল। তবে ইতিমধ্যে পুলিশের নতুন আইজিপি নিয়োগ পেয়েছেন। র‌্যাবের ডিজিরও পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ বিচারবিভাগেও এসেছে কাঙ্খিত পরিবর্তন। বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীন। আপীল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতিও ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন এবং নতুন চারজন বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। ডিজিএফআইসহ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছে পরিবর্তন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সহ কয়েকজন ডেপুটি গভর্ণর ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। এভাবে প্রতিদিনই সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পদে পরিবর্তন আসছে। প্রশাসনে সচিবালয়সহ মাঠপর্যায়ের প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। বিগত সরকারের দলীয়করণের আরেক উদাহরণ নির্বাচন কমিশন। শঠতার আশ্রয় নিয়ে বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণের সাথে সিম্পলি প্রতারণা করেছেন নির্বাচন কমিশন। সেজন্যে পুরো কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। দুদককেও নতুনভাবে সাজাতে হবে, যাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন, এনবিআর, ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএকেও নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। মোটকথা একটি সুষ্ঠু সুন্দর নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চাইলে এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলে লেবেল প্লেইং ফিল্ড ঠিক করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে হবে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ইতিমধ্যে বলেছেন ‘যতদিন প্রয়োজন এই সরকার থাকবে; বেশিও না, কমও না’। তড়িঘড়ি করে নির্বাচন করলে ভবিষ্যৎ সরকারও যে স্বৈরাচারী হয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবে না তার গ্যারান্টি নাই। মোটকথা, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামত করে সাংবিধানিক পদে যথার্থ যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।

সময়ের করণীয়: 

১. দেশ ধ্বংসকারী ষড়যন্ত্রে ল্পি যারা গা ঢাকা দিয়ে দেশ-বিদেশে আছে, তাদের আইনের আওতায় এনে সকলের অভ্যন্তরিন ও আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা সময়ের অনিবার্য দাবী।

২. প্রশাসনের পদায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৌশলী হয়ে দায়িত্ব অর্পণ করা দরকার। বিশেষ করে ভিন্ন মতালম্বি দুষ্ট ব্যক্তিদের এখনকার মিষ্ট আচরণে যেন প্রভাবিত না হই। যার ফলাফল কিছু রদবদল এখনই শুরু হয়েছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের এ ব্যাপারে বিশেষ ভাবে নজর দেয়া দরকার।

৩. সালমান এফ রহমান, সজীব ওয়াজেদ জয় সহ পাচারকারীদের সমদয় টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি।

৪. দেশের টাকা আত্মসাতকারী বিভিন্ন কোম্পানী ও ব্যক্তি প্রভাবে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করার ক্ষেত্রে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে নিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা এবং যথার্থ বিচার করতে হবে।

৫. দূর্নীতির সাথে জড়িত রাঘোব বোয়ালদের চিহ্নিত করে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং সমুচিত বিচারের কাঠগড়ায় আনতে হবে।

৬. বাজার সিন্ডিকেটের সাথে যারা দীর্ঘদিন জড়িত থেকে দেশের সাধারণ মানুষের নিত্যদিন কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে এস আলম, বসুন্ধরা, ফ্রেশ, কাজী গ্রুপসহ প্রথম শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে।

৭. শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তনের জন্য যথার্থ যোগ্য-দক্ষ শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাদ্রাসা , শিক্ষাবোর্ডগুলো নতুন করে সাজাতে হবে।

৮. দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নতুন ভাবে আইনি ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা কর্মে নিয়োজিতদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং বিশেষভাবে সতর্কতার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

 বর্তমানে দেশের সব থানা চালু করে পুলিশের সেবাধর্মী ও আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম শতভাগ নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বর্তমানে বিশাল চ্যালেঞ্জ। পুলিশস্বল্পতার কারণে ইতিমধ্যে দেশের বহু জায়গায় চুরি ডাকাতি সংগঠিত হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের অভাবে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রাস্তায় নেমে বিগত এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী এবং অবৈধ সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙ্গতে হবে। রপ্তানী বৃদ্ধি করে এবং বিদেশে নতুন নতুন শ্রমবাজার প্রসারিত করার মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি না করা গেলে চাপের মুখের থাকা অর্থনীতি ঝুঁকিমুক্ত হবে না। রিজার্ভ আমাদের বাড়াতেই হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী গণহত্যার উপযুক্ত বিচার এবং বিগত সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার, অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের চিহ্নিতকরণ এবং বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোট হরণকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করা না গেলে এদেশে স্বৈরাচার বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। হাজারো ছাত্রজনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আমাদের জন্য যে নতুন স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এবং যে অবারিত সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছেন আমরা আপামর জনগোষ্ঠী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা না করলে একা সরকারের পক্ষে সবকিছু সমাধান করা সম্ভবপর নয়। শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম ও মুগ্ধরা যে নতুন বাংলাদেশকে দেখার লক্ষ্যে নিজের প্রাণ সঁপে দিয়েছেন সে দেশকে সাজানোর জন্য দল মত ভুলে আমরা একে অপরের হাতে হাত রাখি। যতদিন সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারব না, তত দিন আমরা সভ্য হতে পারব না। ন্যায়ের পথে উত্তোরণের জন্য বাচ্চা সমতুল্য শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন সে পথ থেকে বিচ্যুরিত হলে ইতিহাস আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না । সে কথা মাথায় রেখে দেশ পরিচালনায় এগিয়ে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ।

 

 


অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ