news-details

ওরা আবার মাঠে নেমেছে: প্রশাসনের নীরবতায় জনদুর্ভোগ চরমে

ছবি: সংগৃহীত


গুম খুনের দুঃসহ যন্ত্রণা আর নির্ঘুম রাতের অবসান হলেও দু:শ্চিন্তার পাহাড় আর ষড়যন্ত্রের অক্টোপাসের বেষ্টনী নতুনভাবে গাঁ ছাড়া দিয়ে উঠেছে আবারো। অশরিরী ছায়ার মতো দেশের মানুষ আবার যেন কোন ইঙ্গিত পাচ্ছে রাজনৈতিক প্রবাহে। হাজারো সন্তানহারা মা, বাবা হারা সন্তান, আর স্বামীহারা স্ত্রীর দুঃখভরা পাষাণ সরে স্নিগ্ধ সকালের অবতারণা ঘটলেও চিন্তার আকাশে আবার কালো মেঘের ঘনঘটা ধীরে ধীরে ধুমায়িত হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৫ই আগস্ট ভারতে পালানোর পর হতে ভারতের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত প্রতিনিয়ত তাদের অপকৌশল গাটছাড়া বিবৃতি, সীমান্তে অপ্রত্যাশিত নয়া নির্দেশনা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের প্রশাসনে থাকা বিষধর সাপের মত ঘাপটি মেরে বসে আছে তাদের দোসররা। কখন যেন এদেশের উপর আবারো হামলা চালায়। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। শেখ হাসিনা বিদায়কালে পুলিশের আইজিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিল যে “আমি যদি চলে যাই, তোমরা এদেশে এমন অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করবা যাতে ২০-২৫ বছরে এদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।”

ইতোমধ্যে পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, অনলাইনে খবরে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের দুর্ভোগ গরমে অতিষ্ঠ হওয়া, কলকারখানা অচল অবস্থা এবং অফিস আদালতে মানুষের কষ্টের সীমা নেই। সকলক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ঘাটতি আর নিয়মিত লোডশেডিং মানুষকে বিষিয়ে তুলছে। ২য় স্বাধীনতা ও নতুন অভ্যুত্থানের পর সমাজের সব শ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে এক ধরনের স্বস্তির বাতাস ও মুক্ত মনে চলার স্নিগ্ধতা খুঁজে পেলেও তা যেন নিরাশার বালুচরে পরিণত হচ্ছে। 

নিয়মিত বিদ্যুৎ না থাকায় দেশের সকল কাজ অচলবস্থায় পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি মানবজীবনে অস্বস্তি-অশান্তির কালো মেঘের গর্জন যেন নতুনভাবে আঘাত হানতে আবার শুরু করলো। বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কর্মকর্তারা নানান কথা বলে নিউজে দিলেও পিছনের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পিত হিংসা রাজনীতির কথা অনুধাবন করা দূরহ ব্যাপার। 

বিদ্যুতের ঘাটতি দেখাতে পারলে কলকারখানা অচল হয়ে পড়বে। উৎপাদন ব্যাহত হলে অর্থনীতির অবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তখন সরকারকে ধাক্কা দিতে সহজ হবে। ইতোমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদী রক্তখেকো ভারতে বসে নানা হুমকি-ধমকি ও ফোনালাপ ফাঁসের নামে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে মানুষের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতি সম্পর্কে জানা যায় যে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে দেশজুড়ে বেড়েই চলেছে লোডশেডিং। এই গরম এবং ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে জনজীবন। রাজধানীতে তেমন লোডশেডিং না হলেও রাজধানীর বাইরের জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং পরিস্থিতি অসহনীয়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) জানা যায়, সাড়ে তিন মাস ধরে সামিট গ্রুপের একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় দৈনিক এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। বকেয়া পরিশোধ না করায় ভারতের আদানি গ্রুপও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। আবার কয়লাসংকটে মাতারবাড়ী এবং এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়া কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনও। বকেয়ার কারণে বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এসব কারণে দেশে বিদ্যুতের বড় ঘাটতি তৈরি হয়ে লোডশেডিং বেড়েছে বলে জানান তারা।

বিপিডিবির দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম। কিন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট। তবে বর্তমানে দৈনিক গড়ে ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ায় দৈনিক লোডশেডিং করতে হচ্ছে দু-তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। দেশে লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৮৭৩ মেগাওয়াট। এ সময় ১৪ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট। পিজিসিবির দৈনিক প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় বর্তমানে অন্তত দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য তথ্যে জানা গেছে, ‘সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট কমেছে। অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের এটি বড় একটি কারণ। এ ছাড়া বকেয়ার কারণে আদানি গ্রুপ তাদের সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩০০ মেগাওয়াট কম সরবরাহ হচ্ছে। এদিকে কারিগরি ত্রুটির কারণে পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বড়পুকুরিয়ার। মূলত এসব কারণে বর্তমানে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। সামিটের টার্মিনালটি সচল হলেই লোডশেডিং পরিস্থিতি অনেকটা কমে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

একই সুর দৈনিক পত্রিকায় দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এই প্রতিষ্ঠানের বিতরণ এলাকায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম সরবরাহ পাওয়ায় তাঁদের বিতরণ এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল সরবরাহ করা হয়েছে দুই হাজার ৫৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪২৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। স্বাভাবিক সময়ে দুটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে এক হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। গতকাল একটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৫৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে।

আবারও দেশজুড়ে দুর্ভোগের কারণ লোডশেডিং। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের দিনে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা করে। ঢাকার বাইরের চিত্র আরও দুর্বিষহ। দিনে কখনো লোডশেডিং ছাড়াচ্ছে দুই হাজার মেগাওয়াট। মূলত বড়পুকুরিয়া বন্ধ, আদানির কম সরবরাহসহ অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে জ্বালানি সংকটেই দেখা দিয়েছে তীব্র লোডশেডিং।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের দিনে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা করে। ঢাকার বাইরের চিত্র আরও দুর্বিষহ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, মধ্যদুপুরে বিপণিবিতানগুলো ভুতুড়ে পরিবেশ। বিদ্যুৎ না থাকায় থমকে গেছে স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা, কমে গেছে বিক্রিবাট্টাও। কেউ বিকল্প উপায়ে কাজ চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত। রাজধানীবাসী বলছেন, কয়েকদিন ধরে হঠাৎই বেড়েছে লোডশেডিং। অসহনীয় গরমে দিনে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায়, চরম অতিষ্ঠ করে তুলছে যাপিত জীবন তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে ১৪ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটেই ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যুৎ চাহিদা। তারপরও কখনো কখনো লোডশেডিং ছাড়াচ্ছে দুই হাজার মেগাওয়াটে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে ২৭ হাজার উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও কেনো তীব্র লোডশেডিং?

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও পিজিসিবির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিকাল ৫টায় দেশে সন্ধ্যার গুরুত্বপূর্ণ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪ হাজার ৪৭৩ মেগাওয়াট হয়েছে। অন্যদিকে চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং সরবরাহের পূর্বাভাস ছিল ১৬ হাজার ৫৩০ মেগাওয়াট। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে লোডশেডিং এড়াতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায়, এই গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিংয়ের মাত্রা গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ৩ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাস উৎপাদন হয়েছে দৈনিক ৩ হাজার ৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট।

এতে দেখা যায়, বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে যেগুলো প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে, গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২ হাজার ৩১৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ঘটফুট গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে।

নানান সমস্যা দেখিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে হাইলাইট করা হলেও এটা একটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে রুপ নিয়েছে। এ ব্যাপারে দেশের শিশু সরকার ও তেমন উদ্যোগ এখনো গ্রহন করেনি। তবে এর রেশ বহু গভীরে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো সচেতন ও কৌশলী হয়ে সমাধানে না গেলে ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান আর হাজারো তরুণের রক্ত ঝরা নতুন স্বাধীনতার প্রতি অসম্মান করা হবে। 


অধ্যক্ষ আবুল কালাম আযাদ