ফাইল ছবি
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোয় সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। আদালতগুলোয় তিন হাজারের বেশি লোক নিয়োগ হয়েছে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা থেকেই। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। সাবেক এই মন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা-আখাউড়া থেকে আদালতগুলোয় একচেটিয়া জনবল নিয়োগ দিয়েছেন।
এসব নিয়োগ নিয়ে বিস্তর দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ-অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়ায় বিচার বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিচার বিভাগে নিয়োগ নিয়ে এই তুঘলকি কাণ্ড দেখে হতবাক ও বিস্মিত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরে নিয়োগবিধি সংশোধন করে বিচার বিভাগে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের হাতে ন্যস্ত করা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে লোকবল নিয়োগের জন্য একজন অতিরিক্ত ও একজন যুগ্ম জেলা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজের সমন্বয়ে প্রার্থী বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি প্রার্থী বাছাই করে নিয়োগের জন্য জেলা জজের কাছে সুপারিশ করেন। সুপারিশ অনুযায়ী জেলা জজ নিয়োগ দিয়ে থাকেন; কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। ওপরের হস্তক্ষেপে নিয়োগ নিয়ে বিরক্ত অনেক জেলা জজও। এ অবস্থায় নিয়োগবিধি সংশোধন হচ্ছে।
বিধি সংশোধনের পর নিয়োগ প্রার্থী বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ হবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন। এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব, আইন সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ ১০ সদস্যের এই কমিশন পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাই করবেন। এরপর প্রার্থী তালিকা তৈরি করে নিয়োগের সুপারিশ করবেন। তালিকা থেকে জেলা জজ নিয়োগ প্রদান করবেন। এতে করে নিয়োগের ক্ষেত্রে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই লক্ষ্যে এরই মধ্যে জেলা জজ ও অধস্তন আদালতসমূহ এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতসমূহ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮৯ এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসির আদালতসমূহ (সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০০৮-এর সংশোধনী খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল এই খসড়া অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘নিয়োগবিধি পরীক্ষণ-সংক্রান্ত উপকমিটি’ এটি যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সম্পন্ন হলেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত নিয়োগবিধির প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, ‘নিয়োগবিধি সংশোধনের এই উদ্যোগ খুবই যুগোপযোগী। বিচারালয়কে পবিত্র রাখতে এটার বিকল্প নেই। নিয়োগ-দুর্নীতি করে নির্বাহী বিভাগের লোক, আর এর দায় পড়ে বিচারকদের ওপর। আমি মনে করি, এই সংশোধনী কার্যকর হলে বিচারকদের গায়ে কোনো দুর্গন্ধ লাগবে না।’
‘নিয়োগ বিধিমালা সংশোধনের খসড়ায় যা বলা আছে’
বিচার বিভাগের সহায়ক জনবল নিয়োগের জন্য প্রচলিত দুটি নিয়োগ বিধিমালার সংশোধনীতেই বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ (জেলা জজ) বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ (সার্ভিস কমিশন) কর্তৃক বাছাইকৃত উপযুক্ত প্রার্থীদের তালিকা থেকে ওই পদে নিয়োগদান করবেন। সরাসরি নিয়োগে বাছাইকৃত প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ কোনো প্রার্থীর লিখিত, ব্যবহারিক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয় বিবেচনা করবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত উপযুক্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রাপ্তির ১৫ (পনেরো) কার্যদিবসের মধ্যে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শূন্যপদে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।
খসড়াবিধিতে বলা হয়েছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে সরাসরি নিয়োগের লক্ষ্যে শূন্যপদের তালিকা বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করবে এবং বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ সব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত শূন্যপদগুলোর সংখ্যা একত্রিতভাবে প্রতি বছর এক বা একাধিকবার বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের প্রয়োজনে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণে জুডিশিয়াল সার্ভিসের কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ড/বোর্ডসমূহ গঠন করতে পারবে এবং উক্ত বোর্ড/বোর্ডসমূহে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিকে কারিগরি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
বিশেষ বিধান করে এই খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে চলমান কোনো সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন না হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বৈধ প্রার্থীদের আবেদনসমূহ, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে বাছাইকারী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করবে। বাছাইকারী কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আবেদন, তদ্সংযুক্ত কাগজাদি (যদি থাকে) ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রাপ্তির পর তার ভিত্তিতে বাছাইসংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং এ ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদন আহ্বানের প্রয়োজন হবে না। তবে বিধিমালার এই সংশোধনী কার্যকর হওয়ার তারিখে কোনো নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে সরাসরি নিয়োগের কার্যক্রমে লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকলে এবং তৎপরবর্তী কোনো ধাপ অনিষ্পন্ন থাকলে ওই পদের নিয়োগ ও বাছাই কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করতে হবে যেন বিধিমালার এই সংশোধনী জারি হয়নি।
‘নিয়োগ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যা শুরুর এক দিন আগে গত ৫ জুলাই খুলনার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৬৬ জন কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনী এলাকা কসবা থেকেই ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন। এই নিয়োগে ৫০ জনের তালিকা পাঠিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের এই আইনমন্ত্রী। তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ না দিলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখারও হুমকি দেন সাবেক এই মন্ত্রী। এ নিয়ে খুলনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি হয়। পরে স্থানীয় নেতারা তৎকালীন আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তার পাঠানো তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে ছোট করা হয়। বাকি পদগুলোর মধ্যে খুলনার শেখবাড়ি হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের সুপারিশে ১০ জনসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগাভাগি করে নেন। শুধু খুলনার আদালতেই নয়, গত ২৮ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত পঞ্চগড় জেলা ও দায়রা জজ কার্যালয়ে যোগদানকৃত ৩৪ জনের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার ১৮ জন। সিরাজগঞ্জ আদালতে নিয়োগকৃত ৩৪ জন কর্মচারীর মধ্যে ২২ জনই ছিলেন কসবা-আখাউড়ার। একইভাবে ঠাকুরগাঁও জেলা জজ আদালতে ১০ জন এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জন, ফেনীতে ১৩ জন, কুমিল্লায় ৩২ জন কসবার প্রার্থী নিয়োগ পেয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বাকি জেলাগুলোতেও একইভাবে টাকার বিনিময়ে কসবা-আখাউড়ার লোক নিয়োগ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী।
এনএনবিডি ডেস্ক