news-details

বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি খোলা চিঠি

নাম - ছবি : সংগ্রহীত


শ্রদ্ধাস্পদেষু,
মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, আসসালামু আলাইকুম।
আপনি বাংলাদেশে অসাধারণ জনপ্রিয় একজন নেত্রী। আপনি এ দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, তিনবার আপনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। আজ পর্যন্ত আপনার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। আপনি সংসদের যে আসনেই প্রার্থী হন সেখানেই পাহাড় সমান ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। একসাথে পাঁচ আসনে দাঁড়ালে সবখানেই নির্বাচিত হন। আপনার জনপ্রিয়তায় ভাগ বসানোর মতো নেতা এখনো বাংলাদেশে জন্মায়নি। ১১ বছর আপনি ক্ষমতার বাইরে, তবুও আপনার জনপ্রিয়তার এতটুকু ঘাটতি হয়নি। সম্প্রতি আপনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এলে যেভাবে জনগণ আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর ছিল। আপনি যখন রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার, টেকনাফ সফরে বের হলেন, তখন এ দেশের মানুষ আপনাকে যেভাবে সম্মান দেখিয়েছে, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এ দেশের মানুষ জিয়া পরিবারের প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ বহুবার দিয়েছে। আপনার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর নামাজে জানাজায় তত বেশি লোক হয়েছিল, যেমন হয়েছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামাজে জানাজায়।

আপনাকে জনগণ ‘আপসহীন নেত্রী’, ‘দেশনেত্রী’, ‘লৌহমানবী’ ইত্যাদি বিশেষণে ডাকে। কারণ, আপনি কঠিন নির্মম পরিস্থিতিতেও দৃঢ় থাকতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিলে তা কেউ টলাতে পারে না। এ জন্য আপনার ব্যক্তিত্বকে সবাই শ্রদ্ধা করে। এই ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে আপনার মার্জিত কথা বলা, রুচিবোধ, পোশাক-আশাক, আপনার লাইফস্টাইল সর্বোপরি আপনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। আপনার একটা নির্দেশ পেলে জনগণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাবে। আপনি দেশের স্বার্থে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। আপনি পাল্লা দিয়ে ওজন করে কথা বলেন। আপনি কোনো বেফাঁস বা ফালতু কথা ও হালকা কথা বলেন না। তাই জনগণ আপনাকে এতটা শ্রদ্ধা করে।
এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনবার। আপনার সরকার মানে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত রাষ্ট্র। আপনার সময় দেশে ছিল সোনালি যুগ। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কলামিস্ট ‘গোলাম মাওলা রনি’ গত ১৮ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ তার এক নিবন্ধে আপনার সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন এভাবে- ‘যিনি শিক্ষামন্ত্রীর পদ ও পদবিটিকে রীতিমতো ক্রেজে পরিণত করেছিলেন। হিন্দি ছবির নায়ক কিংবা জেমস বন্ডের ছবির নায়কের মতোই তিনি দেশের কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত হিসেবে আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। লোকজন তাকে ভালোবাসত এবং অন্যায়কারীরা ভয় পেত। নকলের বিরুদ্ধে তার দুর্বার সংগ্রাম এবং নাটকীয় সফলতা এ দেশের শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। মন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি বিগত বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের কথাই বলছি। বর্তমান জমানায় পরীক্ষায় নকল করা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা এবং ফলাফল জালিয়াতি অর্থাৎ না লিখে নম্বর পাওয়া, খাতা বদল, প্রক্সি দেয়া ইত্যাদি কর্ম রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অপরাধীরা রাষ্ট্রশক্তিকে টেক্কা দিয়ে নিজেদের সফলতা নিয়ে বড়াই করছে এবং অপকর্মকে রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।’ মাননীয় নেত্রী, এটা আপনার সরকারের সময়ের মাত্র একটা বিভাগের দৃষ্টান্ত। অথচ আজ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। কেউ আর পড়ালেখা করতে চায় না। শুধু কষ্ট করে পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করলেই হয়, হাজার হাজার জিপিএ ৫। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়, দেশের প্রতিটি সেক্টর আজ ভেঙে পড়েছে।

কেমন করে স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয় তা মানুষ ভুলে গেছে। সুষ্ঠু স্বাধীন নির্বাচন পদ্ধতির জন্য আপনি লাগাতার সংগ্রাম করছেন। দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে কখন একটা স্বাধীন ভোট পদ্ধতি চালু হবে আর আপনাকে নির্বাচিত করবে। স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচিত হতো না তা শুধু জনগণ না স্বয়ং সরকারের মন্ত্রীই বলে দিলেন, আওয়ামী লীগ এক হাজার বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। রাজনীতিতে খুচরা পয়সাওয়ালাদের গলাবাজি বেশি। আপনি ২০ দলীয় জোটের নেত্রী। কিন্তু কেন বিএনপি চারদলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোটে পরিণত হলো? বিএনপির কি জনপ্রিয়তার এতই অভাব যে, জোট ছাড়া এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোটে জিতবে না? বিএনপি ভোটে নির্বাচিত হবে নিজ যোগ্যতা তথা জিয়া পরিবারের জনপ্রিয়তায়। ক্ষমতায় আসা বা থাকায় ছোট দলের কোনো ভূমিকা নেই। এ দলগুলো বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সরকারের সাথে নামের ভাগ নেবে, কিন্তু অসুবিধা দেখা দিলে সরে পড়বে। ‘খুচরা’ পয়সার দলগুলোর সাথে জোটে থাকা জরুরি কি না আপনি ভেবে দেখবেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বড়দের প্রতি বেয়াদবি করা আজ সাদামাটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্বয়ং সরকারের বড় মন্ত্রীরা যে কত অশ্লীল ভাষায় সম্মানিতদের সম্বোধন করে কথা বলেন, তা না শুনলে বিশ্বাস হয় না। তারা শহীদ জিয়াকে ‘রাজাকার’, আল্লামা শফী হুজুরকে ‘তেঁতুল হুজুর’ আপনাকে ‘গোলাপি বেগম’ বলে এবং গালি দেয়। অথচ একদিন সংসদে সন্তু লারমা ও শেখ হাসিনাকে একত্রে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব পেশ করা হলে আপনি তীব্র প্রতিবাদ জানালেন এই বলে যে, ‘একজন প্রধানমন্ত্রীর সাথে একজন সন্ত্রাসীর তুলনা করবেন না।’ তারা আপনাকে মূর্খ ও অশিক্ষিত বলে সম্বোধন করে। সম্মান দিয়ে কথা বলা আপনার স্বভাব হলেও সবাই এটা পারে না। আপনার সাথে এই সরকার যে অমানবিকতা দেখিয়েছে তা দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। আপনাকে দান করা ক্যান্টনমেন্টের যে বাড়িতে আপনি ৩০ বছর ছিলেন, সে বাড়িটি সরকার কেড়ে নিলো। আপনি জীবনে প্রথম প্রকাশ্যে কাঁদলেন। আপনি স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলন করলেন, কষ্ট করলেন, আপনাকে কেউ টলাতে পারেনি। আজো আপনি সেই ধৈর্য নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

৩২টি রাজনৈতিক মামলা মাথায় নিয়ে আদালতের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন, আপনার একটা ছেলে মারা গেল, একটা ছেলে দেশান্তরী হলো। আপনি একটানা তিন মাস গুলশান কার্যালয়ে বন্দী ছিলেন। নিজের সুখের কথা না ভেবে ছোট্ট একটি কামরায় আপনি করলা-সবজি খেয়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন। দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে আপনি সরকারের কাছে নিজের দাবি থেকে এক চুলও নড়েননি। সম্প্রতি গত ১২ নভেম্বর আপনি দুই বছর পর জনসভা করার সুযোগ পেলেন। জনগণ আপনার বক্তব্য শোনার জন্য পাগলপারা। আপনি শুধু সরকারের অত্যাচার হজম করেননি, আপনি প্রকাশ্যে জনসভায় জানিয়ে দিলেন, আপনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। যে বক্তব্য দিলেন, তাতে আপনার মহানুভবতার পরিচয় আবার পাওয়া গেল। জানিয়ে দিলেন রাজনীতিতে গুণগত পরির্বতন আনবেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করবেন। এতে আপনার সম্পর্কে দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যে কত উচ্চতায় বেড়েছে তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আপনার মুখের কথাই দলিল বলে সবাই বিশ্বাস করে। আপনার কথাগুলো যে নিছক রাজনৈতিক কথা নয় তা জনগণ বিশ্বাস করে। কিন্তু আপনার কথাগুলো অত্যন্ত দামি হলেও আপনার মতো এমন মহৎ হৃদয়ের সম্মান রক্ষা করতে পারবে কি না জানা নেই। তারা এই সরকারের নির্যাতন সহ্য করে ধৈর্য ধরে আছে, কখনো বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নির্যাতনকারীদের বিচার চাইবে। কিন্তু আপনি একবাক্যে সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। এটা কোনো ধর্মীয় বিষয় নয় যে অতীতের সব অপরাধ ক্ষমা করা হলো। কর্মীদের মনের জ্বালা আপনি ক্ষমা করে দিলেই কি মিটবে বলে মনে হয়?

আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এ দেশটি আজ একটা দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, নকল আর ভেজালের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে গত ২৭ নভেম্বর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরছি- “নকলবাজিতেই সব বন্দী (শিরোনাম), দেশে নাগরিক জীবনযাত্রার সব কিছুই নকলবাজিতে বন্দী হয়ে পড়েছে। একদা কেবল পরীক্ষার ক্ষেত্রে টুকিটাকি নকলের কথাই জানা ছিল মানুষের। এখন নকল জন্মদান থেকে শুরু করে ‘ভুয়া মৃত্যু’ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই নকলের একচ্ছত্র দাপট। নকলবাজির এ সাম্রাজ্যে সবই আছে, শুধু আসলটাই উধাও। বাজারে এমন কিছু নেই যা নকল হয় না। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে সার, কসমেটিকস, পানীয়, ইলেকট্রনিক, অটোমোবাইল পার্টস, পাইপ, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, ভুয়া ডাক্তার, ভুয়া পুলিশ, ন্যাশনাল আইডি- কী নেই নকল?” দেশ আজ শুধু নকলের রাজত্বে নয়, সামাজিক অবক্ষয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। মূল্যবোধের জায়গায় বাংলাদেশ আর নেই। বিশেষত গত ৯ বছরে সব হারিয়ে গেছে। গুম-খুন-ধর্ষণ আজকাল যেন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। চরিত্রহীন নষ্ট মানুষে ভরে গেছে বাংলাদেশ।

স্বাধীন একটা নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হবে। আর আপনি হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। মানুষ আপনাকে নির্বাচিত করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে আবার দেশের দায়িত্ব নিলে আপনি কি এ দেশটির কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগ পাবেন? আপনার সেই যোগ্যতা আছে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনাকে কি দুষ্টচক্র সেই সুযোগ দেবে? প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু গণতন্ত্রবিরোধী জিয়ার দেশ গড়ার মন্ত্র চিরতরে নিভিয়ে দিলো। ৭০ বছরের অধিক বয়স আপনার। শরীরের অবস্থা তেমন ভালো না। জীবনের সোনালি দিনগুলো পার করলেন দেশের কথা, জনগণের কথা ভেবে। গত এক যুগ আপনি ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু জনগণ জানে আপনি মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। এ দেশের নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষগুলো আপনাকে ভালোভাবে থাকতে দেবে না। আপনি নিজের জন্য এবার একটু সময় দিন। আপনি বিশ্রামে থাকুন। জনগণের হৃদয়ে আপনি ‘দেশমাতা’ হয়ে বেঁচে থাকুন অনন্তকাল।

লেখক : পাঠক, নয়া দিগন্ত; ছাগলনাইয়া, ফেনী


হারুনুর রশিদ আরজু